আবু সালেহ বাংলা ছড়াসাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা। ছড়াসাহিত্যের অঙ্গনে তাঁর দীর্ঘ পদচারণা ও নানান বিষয় নিয়ে কথা হয় তাঁর সাথে। সেই কথাগুলোই আপনাদের জন্য তুলে ধরা হল।
প্রশ্ন: শুভ সন্ধ্যা। কেমন আছেন আপনি?
উত্তর: মোটামুটি। ওষুধের ওপর থাকি তো। ভালোও বলা যায় না আবার মন্দও বলা যায় না।
প্রশ্ন: ফেসবুকে তো নিয়মিতই আপনার নতুন নতুন ছড়া দেখছি। এতো লেখার সময় পান কিভাবে?
উত্তর: এটা আমার রুটিন ওয়ার্ক। সকালে লিখি দু’একটা, দুপুরে দুই-দিনটা লিখি আবার রাতেও লিখি। কখনও কখনও একসাথে অনেকগুলো লিখি। আজকাল তো আর কলমে, কাগজে লিখি না, টাইপ করি।
প্রশ্ন: আপনার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৫৪ সালে মুকুল ফৌজের দেয়াল পত্রিকায়। সেটি কি ধরণের লেখা ছিল?
উত্তর: পদ্য। শরতের ওপর বেশ লম্বা ছিল লেখাটি। সেটি আমার মা এডিট করে চার লাইন করে দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: তার মানে আপনার মা সাহিত্য সম্পর্কে জ্ঞান রাখতেন?
উত্তর: তা তো ছিলই। সেই সূত্রেই তো লেখালেখির জগতে আসতে পেরেছি।
প্রশ্ন: সেই ষাটের দশকের শুরু থেকেই ছড়া নিয়ে আছেন। কয়েকটি বই ‘হাজার ছড়া’ দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে আপনার।
আমাদের ছড়া সাহিত্য আপনার কাছ থেকে কি পেয়েছে আর আপনিই বা কি পেয়েছেন?
উত্তর: আমি ছড়ার মাধ্যমে বঞ্চিত, নিপীড়িত, অবহেলিত, সর্বহারাদের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। আমার ছড়াগুলো তাদেরকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে। সমাজ পরিবর্তনের জন্য ছড়াকে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছি। অনেক ছড়া রাজনৈতিক আলোচনায় ও স্লোগানে পরিণত হয়েছে। আমি এবং আমার বন্ধুরা মিলে ছড়াকে ঘুম পাড়ানোর ছড়া থেকে ঘুম তাড়ানোর ছড়ায় পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন: সাহিত্যের মানুষেরা রাজনৈতিক বিষয়ে লিখতে চায় না। কিন্তু আপনার ছড়ার অনেকটা স্থান জুড়ে আছে রাজনীতি। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
উত্তর: কথা একেবারে ও রকম নয়। রাজনীতি বর্হিভূত লেখা আমার চোখে খুব একটা পড়েনি বা সাহিত্যিকেরও দেখা মেলেনি। কোন লেখক তার লেখায় যে রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আনেননি তা ঠিক নয়। বঙ্গিম ‘বঙ্গে মাতরম’ বলেছিলেন। এটি রাজনৈতিক। রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ বলেছিলেন। এটিও রাজনৈতিক লেখা। নজরুলকেও দেখেছি। তিনি তো শুধু রাজনৈতিক লেখাই লেখেননি; রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, কবি বেনজির আহমেদ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় আর কতো নাম বলবো। কেউ তো অরাজনৈতিক নন। কেউ রাজনীতিক হয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রচার করেছেন, আবার কেউ কেউ রাজনীতিক না হয়ে অন্যভাবে করেছেন।
প্রশ্ন: বাংলা ছড়াসাহিত্য নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
উত্তর: ছড়ার বিষয়ে কোন পর্যবেক্ষণ নেই। যুগেযুগে, কালেকালে সমকালীন সময়ে ছড়া সাহিত্য নিজেই পর্যবেক্ষকের ভূমিকা পালন করেছে। আগামী দিনের ছড়া বিবেচিত হবে সেই সময়ের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে।
প্রশ্ন: লিখিত বিষয়ের ওপর কি আপনার কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা থাকে?
উত্তর: সময়টাকে আমি কিভাবে দেখলাম এবং সময়টা কতটুকু গ্রহণযোগ্য সে বিষয়টা তো থাকেই।
প্রশ্ন: কলকাতার ছড়া আর ঢাকার ছড়ার বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?
উত্তর: কলকাতার অবস্থা আর ঢাকার অবস্থা এক রকম নয়। দুটোকে তো তুলনা করা যাবে না। আমরা যেভাবে কথা বলি তারা সেভাবে বলে না; যদিও সবাই বাংলাতেই কথা বলি। আমাদের উচ্চারণ আর তাদের উচ্চারণ এক রকম নয়। কলকাতার ছড়াকে অস্বীকার করা যাবে না আবার বাংলাদেশের ছড়াকে গুরুত্বহীনও করা যাবে না। তবে এভাবে বলা যায়- ছড়ায় আমরা এগিয়ে আছি।
প্রশ্ন: আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনার সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল। মুক্তিযুদ্ধে ছড়ার ভূমিকা কেমন ছিল? আপনার জানা মতে সেই সময় কোন কোন ছড়াকার ছড়া লিখে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেছে?
উত্তর: এটাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হলো জনমত তৈরি করা আর অন্যটি হলো সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। কেউ কেউ কলম হাতে জনমত তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে, কেউ কলমের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে। আবার কেউ কেউ তো কণ্ঠের মাধ্যমেও ভূমিকা রেখেছে।
প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে বা পাকিস্তানীদের পক্ষে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কেউ কি তখন ছড়া লিখেছিল?
উত্তর: আমাদের বয়সীদের কেউ পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন তেমন কাউকে দেখি না।
প্রশ্ন: নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনে ছড়া এবং ছড়াকারদের ভূমিকা নিয়ে বলুন। তখন কি স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে কেউ ছড়া লিখেছে?
উত্তর: এটা নিয়ে খুব বেশি বলতে চাই না। তবে আমীরুল ইসলাম, ফারুক নওয়াজ, খালেক বিন জয়েনউদ্দীনসহ অনেকেই ভূমিকা রেখেছে। পরে এসে লুৎফর রহমান রিটনও যোগ হয়েছে।
প্রশ্ন: অনেকে মনে করেন আপনার ছড়ায় হাস্যরসের অভাব লক্ষ্য করা যায়। কথাটা কতটুকু ঠিক?
উত্তর: ছড়ায় কাল বা সময়কে দেখা যায়। রাজদরবারে যে সব ছড়া পড়া হতো সেগুলো আনন্দ দেয়ার জন্য। আবার আমাদের সময় যে ছড়া লেখা হচ্ছে তা আনন্দের চাইতে শোষিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত, অধিকার বঞ্চিত মানুষের কথাই বেশি উচ্চারিত হয়েছে। আমাদের সমাজে এখন মানুষ অন্যায়, অত্যাচার, নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি কারণে বিক্ষুব্ধ। দারিদ্রতাও মারাত্মকভাবে রয়েছে। সঙ্গতকারণেই এ সময়ের ছড়াগুলো সময়ের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্র অন্যায় করে। তার হাতে বন্দুক আছে। বন্দুকের বদলে বন্দুক, লাঠির বদলে লাঠি; যে ভাষাতেই আঘাত আসুক সেই ভাষাতেই পরাস্ত করতে হবে। ছড়া সেই ভাষাতেই কথা বলছে।
প্রশ্ন: ভালো ছড়া লেখার জন্য একজন ছড়াকারের কি করা উচিত?
উত্তর: প্রথমত: ইতিহাসের বই পড়া; ইতিহাস জানা। কারণ ছড়ার উৎস ইতিহাস, ইতিহাসের উপাদান ছড়া। ছন্দ সম্পর্কেও জানতে হবে।
দ্বিতীয়ত: বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে মিশতে হবে। তাদের সম্পর্কে জানতে হবে। তাদের দুঃখ-ব্যথা, উপলব্ধি, অভিব্যক্তি সম্পর্কেও জানতে হবে।
প্রশ্ন: ঘুম পাড়ানো থেকে ঘুম তাড়ানো- এরপর ছড়ার গন্তব্য কোথায়?
উত্তর: এরপর ছড়ার গন্তব্য হতে পারে দেশ, জাতি, সমাজ গঠনে ও উন্নয়নে। তবে মানব ইতিহাসে সে সময়টি কখনও আসবে না। মানব সমাজে সমস্যা থাকবেই। সে কারণে ছড়ার আবেদন সব সময়ই সংগ্রামী হয়ে থাকবে।
প্রশ্ন: কবিতা এবং ছড়া- কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন এবং কেন?
উত্তর: ছড়া এগিয়ে ছিল, এগিয়ে থাকবে। প্রথম পাঠই তো হচ্ছে ছড়া।
প্রশ্ন: আমাদের ছড়া সাহিত্যের এমন কি চাহিদা আছে যা এখনো ছড়াকারেরা দিতে পারছে না?
উত্তর: ছড়াকে জনগণের কাছে যেভাবে (ব্যাপকভাবে) পৌঁছানোর দরকার ছিল তা এখনো পারেনি।
প্রশ্ন: সমাজ বিপ্লবে ছড়াকারদের ভূমিকা কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
উত্তর: ছড়াকারেরা এখনও সেই অবস্থানে আসেনি। তাই সমাজ বিপ্লব এখনও ঘটেনি।
প্রশ্ন: ছড়াকে বক্তব্য প্রধান করতে গিয়ে আপনাকে কোন সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে?
উত্তর: সমালোচনা তো এসেছেই আবার বিষোদগারেও পড়তে হয়েছে। যেমন আমার একটি ছড়া- ‘ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা/ রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা’- এটা সবাই মুখে মুখে বলে আবার বিরূপ মন্তব্যও করে। আবার গ্রেফতারের দাবিও জানানো হয়। এ দাবিতে মিছিলও হয়।
প্রশ্ন: ছড়া চর্চায় কোন মাধ্যমটি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে বলে মনে করেন?
উত্তর: পত্রিকার সাহিত্য ও শিশু পাতায়, লিফলেট ও সাহিত্য সভায় পাঠ।
প্রশ্ন: তার মানে লিটল ম্যাগাজিনের কোন ভূমিকা নেই বলছেন?
উত্তর: অবশ্যই লিটল ম্যাগাজিনের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে।
প্রশ্ন: মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার সেই সময়ের কর্মকা- সংক্ষেপে বলুন।
উত্তর: মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাসই আমি সক্রিয় ছিলাম।
প্রশ্ন: বর্তমান সময়ের ছড়াকারদের মধ্যে কার কার ছড়া আপনার পছন্দ?
উত্তর: এটা আলাদা করে বলার সুযোগ নেই। যারাই লিখছে তারা দ্রোহ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম প্রভৃতি বিষয় নিয়েই লিখছে। একেক জনের টেকনিক একেক রকম। কেউ কারো চেয়ে কম নন্।
প্রশ্ন: যখন লিখতে চান কিন্তু কলমে ছড়া আসে না, আপনার তখনকার অনুভূতি কেমন?
উত্তর: এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। আমার লেখা স্বত:স্ফূর্তভাবেই চলে আসে এবং প্রয়োজন হলে পরে কিছুটা সংশোধন করে নিই।
প্রশ্ন: আমাদের রাজনীতির যে ধারা চলছে এ থেকে উত্তরণের কোন সম্ভাবনা দেখছেন কি?
উত্তর: সব যুগে সব কালে রাজনীতির ধারা প্রায় একই রকম। এর উত্তরণ স্বাভাবিক নিয়মেই হয়ে থাকে।
প্রশ্ন: ছড়াকার হিসেবে আপনি কি নিজেকে স্বার্থক মনে করেন?
উত্তর: আমি স্বার্থক কথাটি উল্লেখ করবো না। তবে কিছুটা তৃপ্ত।
প্রশ্ন: পৃথিবীতে আবার ফিরে আসতে হলে আপনি কি হয়ে আসতে চান?
উত্তর: আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি না। অতএব ফিরে আসার প্রশ্ন আসে না।
প্রশ্ন: সব মিলিয়ে আপনি নিজেকে সফল মনে করেন কি?
উত্তর: এখনও না।
প্রশ্ন: যারা আপনাকে পছন্দ করে না তাদের উদ্দেশ্যে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তর: তাদেরকে আমি সম্মান করি। কারণ তারা ব্যক্তিত্বে, মেধায় আমার চাইতে অনেক উন্নত বিধায় আমাকে পছন্দ করেন না।
প্রশ্ন: আর যারা আপনাকে ভালোবাসে?
উত্তর: কেউ ভালোবাসে এ রকম কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। আমি চিরকালই প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছি।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: আমিনুল ইসলাম মামুন
(সাক্ষাৎকারটি এর আগে ছড়াকার মামুন সারওয়ার সম্পাদিত লাটাইতে প্রকাশিত হয়েছিল)
আরও পড়ুতে ক্লিক করুন
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প ।। আকাশবাণী
ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন
বিখ্যাত ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়ার কন্ঠে নিজের ছড়া- ‘ঠিক আছে’ এর পাঠ
সুমনা শান্তা-এর আবৃত্তিতে কবি আমিনুল ইসলাম মামুন-এর কবিতা- ‘ঢাকার ছবি’