আমিনুল ইসলাম মামুন
বৈশাখের প্রথম দিন; পহেলা বৈশাখ। জীবন তার ফুফুর বাসায় যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। ফুফু জীবনকে বেশ স্নেহ করেন। এমন স্নেহ অন্য কেউ পেলে স্নেহদাতার সংস্পর্শ ছাড়া একটি মুহূর্তও কাটতো না, ছায়ার মতো অনুসরণ করতো তাকে। কিন্তু জীবনের পক্ষে তেমনটি তো নয়ই বরং তার কানা-কড়ি পরিমাণও করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতি সপ্তাহেই ভার্সিটির পড়ার পাশপাশি অন্য আরো দু’ তিনটি বই তার শেষ করা চাই। কোন কারণে কোন সপ্তাহে এর ব্যতিক্রম ঘটলে পরের সপ্তাহে সে তা পূরণ করে নেবেই।
ফুফু তাকে কয়েকদিন আগেই বলেছিলেন এবারের পহেলা বৈশাখের দিনটা যেন তার বাসাতেই কাটানোর সুযোগ করে নেয় জীবন। জীবনও তাই করে। আজকের জন্য হাতে অন্য কোন কাজ রাখেনি সে। সকালে ঘুম থেকে উঠে ওজু করে ফজরের নামাজটা সেরে নিল। এরপর সেভটা। এখন গোসলটা। গোসলে জীবনের বেশ সময় লাগে; অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট। গোসল শেষে রুমে এসে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো। সময় দেখে জীবন দ্রুত তৈরী হতে শুরু করল। আটটা দশ বাজে। অথচ আটটায় তাকে ফুফুর বাসায় থাকার কথা। স্বল্প সময়ে তৈরী হয়ে জীবন বেরিয়ে পড়ল। গন্তব্যে পৌঁছতে ঘড়ির কাঁটা পৌঁছল দশের ঘরে। এতটা সময় লাগার কথা ছিল না। পথে গাড়ি জ্যামে পড়েছিল। নববর্ষ উপলক্ষে র্যা লীতে ছেয়ে গিয়েছিল ঢাকার প্রশস্ত অনেক সড়ক। রমনা পার্কের পাশের সড়কটি বন্ধ। সেখানে পার্ক উপচে লোকজন সড়কের ওপর এসে উদ্যাপন করছে বৈশাখের আনন্দ। বাস বিকল্প পথে আসার সময় চোখে পড়ল তরুণীরা শাড়ি পরে দল বেঁধে হেঁটে চলছে। তরুণদের পরণে রয়েছে পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি। তাদের কারো কারো হাতে ঘুড়ি আর নাটাই। কিন্তু সেগুলো উড়ানোর সাধ্য নেই বললেই চলে এই নগর জীবনে।
ফুফুর বাসায় পৌঁছেই জীবনের মনে হলো তার এখানে আসার ব্যাপারে প্রয়োজনটা যেন ছিল তার ফুফাত বোনের। সে-ই তার মাকে প্রভাবিত করেছিল জীবনকে আনতে। জীবনের এই ফুফাত বোনটি কলেজে পড়ে; ইন্টারে। নাম আলো। স্কুল জীবন থেকেই জীবনের প্রতি রয়েছে আলোর দূর্বলতা। সে জীবনকে ভালোবাসে। কিন্তু এর কোন বহিঃপ্রকাশ নেই। কখনো কখনো থাকলেও তা অন্যদের গোচরীভূত হওয়ার মত নয়। জীবন ড্রইং রুমে বসে ছিল। আলো এসে তাকে ডাকলো ডাইনিং টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে বলে। দেরি না করে উঠে গেল সে। আশেপাশে একটু তাকিয়ে চেয়ারটা টেনে বসল। ফুফু এসে তাকে ভাত বেড়ে দিলেন; পান্তা ভাত। সঙ্গে প্লেটে তুলে দিলেন ইলিশ মাছ আর পোড়া মরিচ। বৈশাখের প্রথম দিনে এমন আয়োজন রেস্তোঁরা ভিন্ন কম বাসায়ই করা হয়। আলোর মা প্রতি বছরই এমনটা করে থাকেন। বছরের বিভিন্ন উপলক্ষকে তিনি ঘরের ভেতর উদ্যাপনের চেষ্টা করেন।
জীবন ফুফুর দিকে চোখ তুলে তাকালো। ফুফু বুঝলো ওর ইলিশ ভীতির কথা। ইলিশ মাছকে জীবন বেশ ভয় পায়। কাঁটার ভয়। ইলিশের কাঁটা বেছে খাওয়াতে সে অভ্যস্ত নয়। বাসায় কাঁটা বাছার এ দায়িত্বটা মা’র ওপর বর্তায়। ফুফু আদুরে গলায় শাসনের সুরে বললেন, বেছে খাও।
: ফুফু তুমি তো…
জীবনকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, আমি জানি কি জানিনা তা বলার প্রয়োজন নেই। কাঁটাটা বেছে খাও। সামান্য একটা মাছের কাঁটাতে এত ভয়, জীবন পথের অসংখ্য কাঁটা সরাবে ক্যামনে?
: ও নিয়ে আমি ভাবি না ফুফু।
: ভাবতে হবে, এখন থেকেই তো ভাবতে হবে। বড় হচ্ছিস না দিন দিন?
: পথ যখন চলতেই হবে, কাঁটা সরানোকে ভয় পেলে কি চলবে? চলবে না। ওসব আমি বুঝি। ফুফু বললেন, আমার হাতে অনেক কাজ বাবা। তুমি একটু দেখে-শুনে খেয়ে নাও। জীবন মাথা নেড়ে সম্মতি জ্ঞাপন করল। ফুফু গেলেন রান্না ঘরে; রান্নার কাজে। আবার প্রয়োজন পড়ল ফুফুর। ডাকল জীবন।
: ফুফু ভাতে পানি লাগবে যে। জগে পানি নেই।
পেছন থেকে একটি হাত জগ ধরে তার প্লেটে পানি ঢেলে দিল। প্রথমে জীবন হাতটাকে ফুফুর হাত ভাবলেও হাতটা যে তার অপরিচিত তা বুঝে উঠল পরক্ষণেই। ফুফুর হাতে সোনার বালা ছিল না, একটু আগেই জীবন তা লক্ষ্য করেছিল। মাথাটা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল জীবন। হাতখানা সরে গেল। অপরিচিত একটি মেয়ে। পরণে শড়ি। শাড়ি পরার ধরণই বলে দিচ্ছে ও সব সময় স্যালোয়ার-কামিজ পরে। আজ শাড়ি পরেছে শখের বশে।
কবরীতে কাঁচা গাঁদা ফুল, দু’ হাতে দু’খানা সোনার বালা, পরণের শাড়িটা বেগুনী রঙ্গের আর শাড়ির পাড়টায় সবুজ আর গোলাপী রঙ্গের মিশ্রন। গায়ের রংটা উজ্জ্বল হওয়াতে অসম্ভব রকম সুন্দর দেখাচ্ছে।
জীবন নির্বাক। চোখে-মুখে কিছু একটা বলবার ভাব ফুঠে উঠেছে তার। ফুফু একটি পানির জগ হাতে নিয়ে জীবনের কাছে এলেন। গলাটা একটু খাকরি দিয়ে বললেন-
: জীবন, ও হচ্ছে অপূর্বা। আলোর সাথে পড়ে। আমাদের আর ওদের হোম ডিষ্ট্রিক্ট একই।
কথার মাঝখানেই অপূর্বা এখান থেকে চলে গেল। জীবন খাওয়া শুরু করল। খাওয়া শেষ করে ড্রইং রুমে গিয়ে বসল সে। বসে বসে একাকী কিছুটা সময় কাটালো। একটু পর আলো আর অপূর্বা এসে সামনে বসলো ওর। আলো অপূর্বাকে দেখিয়ে বলল-
: জীবন ভাই, এ হলো আমার বান্ধবী। নাম অপূর্বা।
: এটুকু ফুফুর কাছ থেকে জানা হয়ে গেছে।
অপূর্বা জীবনের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, আপনি কি করেন?
জীবন অপূর্বার দিকে তাকাল। সে বলতে না বলতেই আলো বলল, উনি ভার্সিটিতে পড়েন। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। অপূর্বা, তুই বস্। আমি একটু ভেতর থেকে চা করে নিয়ে আসি – এই বলে সে উঠল।
অপূর্বা বলল, এই বাসায় আমি প্রায়ই আসি; সপ্তাহে অন্তত দু’ দিন। কিন্তু আপনাকে আর কখনো দেখিনি যে? খুবই কম আসেন এখানে তাই না?
: হ্যাঁ, তাই।
: বোধ হচ্ছে আপনি কথাও কম বলেন।
: আসলে সে রকম না।
: তবে কি বেশি বেশি বলে ধরে নেব? তা-ই বা হবে কেন। সে রকম ধরে নেয়ার মতো কিছুতো লক্ষ্য করছি না।
জীবন খানিকটা হাসল। হাসলে ওকে বেশ লাগে ছোট দু’টি টোল পড়াতে। তবে টোল দু’টি গালের মাঝখানে নয়, তা থেকে আরেকটু গড়িয়ে ওপরের ঠোঁটের প্রন্তদেশের কিঞ্চিৎ দূরবর্তী স্থানে। এরপর বলল-
: স্বল্প বা অধিক কোনটাই নয়, যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুতো বলতেই হয়।
বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকে দু’ জনে। তারপর অপূর্বা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে আরো কিছুক্ষণ। জীবনের দিকে তাকাতেই জীবন অপূর্বাকে লক্ষ্য করে বলল, বৈশাখ আমার প্রিয় মাসগুলোর একটি। আজ সেই মাসের প্রথম দিন। জীবনকে লক্ষ্য করে অপূর্বা বলল, সেই বৈশাখ দেখা দিল প্রকৃতিতে। চৈত্রের দাবদাহ কেটে প্রকৃতি নেবে স্বস্থির নিঃশ্বাস। মনে মনে সে ভাবে, এই বৈশাখে ধানক্ষেত চুষে নেবে বৃষ্টির চুম্বন। কিন্তু একথা মুখফুটিয়ে বলার সাধ্য অপূর্বার নেই যে, আজ নব আশার সঞ্চার হলো তার হৃদয় আকাশে।
জীবন উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে জানালার পাশে গিয়ে গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের প্রকৃতিতে দৃষ্টিপাত করে বলে-
: হয়তো এ বৈশাখই মাতাল হয়ে উঠবে আর প্রকৃতিকে করবে লন্ডভন্ড।
জানালার পর্দাটা বাতাসে কিছুটা উড়ছে আর তা গা-কে স্পর্শ করে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। অপূর্বা বলল, বৈশাখ প্রকৃতিকে উজ্জীবিত করুক, দান করুক নতুন প্রাণ – এটাই কামনা।
অপূর্বার কণ্ঠটা বেশ কাছ থেকেই শোনা গেল। পেছন ফিরে তাকাল জীবন। অপূর্বার চোখে-মুখে আবেগের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চোখে ভর করছে যেন রাজ্যের যতো লজ্জা; সব। সলাজ দৃষ্টিতে জীবনের চোখে কিছুক্ষণ চোখ রাখল সে। হালকা গোলাপী রঙ্গের ঠোঁট দু’টো কিছুটা কেঁপে ওঠে। তার এ আবেগের ছোঁয়া যেন জীবনের মাঝেও বিস্তার লাভ করেছে। অপূর্বা তার দৃষ্টিকে সরিয়ে নেয়।
জীবন এসে বসলো যথাস্থানে; যথাস্থানে বসলো অপূর্বাও। কোন কথা নেই। নিঃশব্দ অবস্থান তাদের। জীবন মাথা তুলে তাকায় অপূর্বার দিকে। এ সময় শোনা যাচ্ছিল চায়ের কাপ নড়ার শব্দ। আলো ট্রে-তে করে চা নিয়ে আসছে। মুহূর্তে সে চা নিয়ে রুমে প্রবেশ করল। ট্রে-টা টি টেবিলের ওপর রেখে সে একটি চায়ের কাপ অপূর্বার হাতে তুলে দিল। তিনটি কাপের মধ্যে দ্বিতীয় কাপটি জীবনে দিকে বাড়িয়ে বলল, আপনার কাপে মিষ্টি যথেষ্ট দেয়া হয়েছে। চিনি আরো লাগলে নিয়ে আসতে পারি।
জীবন কাপটি হাতে নিয়ে এক চুমুক দিয়ে বলল, ঠিক আছে। এরপর সে চায়ের কাপটি টেবিলের ওপর রেখে আনমনা হয়ে বাইরে চেয়ে রইল।
কিছু সময় অতিবাহিত হলো নীরবতার মধ্য দিয়ে। আলো বলল, জীবন ভাই, আপনিতো কবিতা লিখেন আবৃত্তিও করেন। এ মুহূর্তে একটা কবিতা লিখবেন?
জীবন মাথা নেড়ে বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে সম্মতি জানালো। তবে এ চূড়ান্ত সম্মতি নয়, অর্ধেকটা যেন বাকি। আলো উঠে গিয়ে পাশের পড়ার টেবিল থেকে কাগজ আর কলম নিচ্ছিল। জীবন অপূর্বার দিকে তাকালো। অপূর্বা ঘাড় বাঁকিয়ে বাকি অর্ধেকটা সম্মতির জন্য সায় দিল। জীবনের সম্মতিতে যেন পূর্ণতা এলো। আলো কাগজ-কলম দেয়ার পর সে খানিকক্ষণ চুপ হয়ে রইল। এরপর লিখলো কয়েক পংক্তি।
হে বৈশাখ
এসেছো তুমি ভুবন মাঝে
ভেঙেছো যে কবরী
এতোদিন তুমি কোথায় ছিলে
রাখিনিতো কোন খবরই।
ধরাকে তুমি করেছো উথাল
স্বস্তি দিবে কি তাকে
মানব, চোখে রঙ মেখে আজ
ধরায় যে ছবি আঁকে।
ছবি কি শুধুই ছবিই থাকবে
বাস্তব হবে কি?
অংকিত যেই ছবিটি আজ
দেখেই চলেছি।
এরপর জীবন কবিতাটি পড়ে শোনালো। অভিভূত হলো অপূর্বা। আলো অবশ্য অপূর্বার মতো এতটা হয়নি। কারণ সে জীবনের এ কবি প্রতিভার সাথে পূর্ব পরিচিত। অপূর্বা জীবনের হাত থেকে কাগজটি নিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলল-
: চমৎকার লিখেন তো আপনি! আপনার আঁকা ছবিটি একদিন ফ্রেম ছেড়ে আপনার জীবনে সত্যি হয়ে ধরা দেবে।
জীবন চুপ করে রইল।
অপূর্বা বলল, কিন্তু আপনার কবিতাটির কোন শিরোনাম নেই, উহ্য আপনার নামটিও। দিয়ে দিন না। দিবেন না?
: না, প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
: কিন্তু কোন পাঠক হাতে নিলেইতো ধাক্কা খাবে। এমন চমৎকার একটি কবিতার সাথে তার নাম নেই যিনি এর স্রষ্টা।
: আমি যে কবি হতে চাই না।
: কারণ জানাতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই?
: তা অবশ্য নেই।
: তবে শুনি।
: কবি-সাহিত্যিকগণ সাধারণ মানুষের তুলনায় ভিন্ন। এ ভিন্নতা প্রধানতঃ চিন্তা-চেতনায়। আমি সাধারণ মানুষ হয়ে সংখ্যাধিক্যের সাথে থাকাটাকে পছন্দ করি। কোন ধরণের বিড়ম্বনা পোহাতে চাই না।
চা এতোক্ষণে প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেছে। আলো কৌতুক করে বলল, চা-তো মনে হয় শরবতে রূপান্তরিত হয়েছে। চুমুক দিয়ে দেখেন অপেয় হয়ে উঠেছে কি না।
: হলে কিন্তু অপরাধটা তোমার।
: আমি মাশুল দিতে আপত্তি করবো না।
জীবন চুমুক দিল। আলো বলল, আরেক কাপ বানিয়ে আনতে হবে?
: তা আর দরকার হবে না। অপেয় হয়নি এখনো।
অপূর্বা খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল, আপনার কবিতাটি আমি নিতে পারি?
: না, পারেন না। কারণ কবি কবিতা লিখেন। যেহেতু আমি কবি হতে চাই না এবং কবির বৈশিষ্ট্য আমার মাঝে বিদ্যমান আছে বলে মনে করি না; সেহেতু রচিত পংক্তিগুলোকে কবিতার পর্যায়ে ফেলাকে আমি অন্যায় বৈ কিছু মনে করবো না।
অপূর্বা বলল, তাহলে আলো প্রথমেই যে বলল আপনি কবিতা লিখেন আর আবৃত্তিও করেন?
: ও যেটাকে কবিতা বলেছে, আসলে সেটা কবিতা নয়, আমার দৃষ্টিতে কয়েকটি সাধারণ পংক্তি মাত্র। আর যেটাকে আবৃত্তি বলেছে, সেটা আবৃত্তি নয়- পাঠ। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আবৃত্তি হলো নিয়মতান্ত্রিক পাঠ আর পাঠ হচ্ছে এর ব্যতিক্রম।
: মানলাম এটি কবিতা নয়। এবার কি অনুমতি পেতে পারি?
: এবার যে ‘না’ বলতে সংকোচ হচ্ছে।
: সংকোচ যখন হচ্ছে, তখন ‘না’ না বলাটাইতো সমিচীন। কি বলেন?
জীবন হাসলো আর মাথা নাড়লো। অপূর্বা বুঝতে পারলো সম্মতি পাওয়া গেছে। সে কবিতাটি একবার পড়ে নিল। তারপর ভাঁজ করলো কাগজটি।
আলো বসা থেকে দাঁড়ালো। জীবনকে বলল, আপনি আমাদেরকে নিয়ে একটু বেড়াতে বের হতে পারবেন?
জীবন ভেবেছিল অপারগতা প্রকাশ করবে। কিন্তু তার আগেই অপূর্বা বলে উঠলো, আপনি কিন্তু না করতে পারবেন না।
তবুও জীবন বলল, বাইরে তাকিয়ে দেখুন। প্রকৃতিতো বাধ সেজে বসে আছে।
আলো বলল, ক্ষণিক বাদেই কেটে যাবে। – বলেই সে চায়ের কাপগুলো ট্রে-তে তুলে নিয়ে ভেতরের রুমের দিকে পা বাড়াল। তাকে অনুসরণ করল অপূর্বাও।
সময় বেশ হয়েছে। দুপুরের খাবারের ঝামেলাও চুকে গেছে এতক্ষণে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে জীবন বাসায় পা বাড়াতে মন স্থির করল। বেড়ানোর ইচ্ছেটা অপূর্ণই রয়ে গেল আলো আর অপূর্বার। আকাশ সেই যে অবুঝ শিশুর মতো ছেঁড়া-খোঁড়া মেঘ বুকে নিয়ে বসে আছে, তার সেই রাগ বাঙ্গানোর সাধ্য যেন এখনো কারো হয়নি বা ইচ্ছে করেই ভাঙ্গাচ্ছে না তার রাগ। আলোর কিছুটা খারাপ লাগলো। আর অপূর্বার মনটাও ভেঙে গেল এমন একটি সোনা মোড়া দিনের শেষ ভাগটা মাটি হলো বলে।
ভেতরে ফুফুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জীবন ড্রইং রুমের সোফায় বসে সু-টা পরে নিচ্ছে। ডান পায়ের ফিতা বাঁধা শেষে বাম পায়ের ফিতায় গিট পড়ে গেল। অপরিচিত একটি মেয়েলি কণ্ঠ কানে প্রবেশ করল। মেয়েটি বলল, আমি কি সাহায্য করতে পারি?
অপরিচিত কণ্ঠ বলে মোটেই আশ্চর্য হয়নি জীবন। বরং আশ্চর্য হয়েছিল তখন, যখন মেয়েটির দিকে তাকালো। মেয়েটি মায়াভরা দু’টি নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে। কিছুটা ইতস্তত করে জীবন বলল, থ্যাংস। এইতো হয়ে গেছে।
জুতার ফিতা বাঁধা শেষে জীবন একটু পায়চারী করতে গিয়ে হোঁচট খেল সোফার পায়ায়। অপূর্বা বলল, এখন বের হওয়াটা উচিত হবে না। যাত্রা শুভ হচ্ছে না আপনার।
জীবন বলল, কেন বলুনতো? হোঁচট খেয়েছি বলে?
অপূর্বা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক জবাব দিল।
: অনেকের মাঝেইতো এ নিয়ে কু-সংস্কার রয়েছে। আপনি দেখছি সেই কু-সংস্কারবাদীদের একজন।
অপূর্বা শান্ত-স্থির হয়ে পাথুরে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখগুলো এমন যেন ক্ষণিকের মধ্যেই আকাশের মেঘ ভেঙ্গে হবে শ্রাবণ। জীবন তখন নিজে নিজেই বলতে লাগলো, অবশ্য এর পেছনেও যুক্তি রয়েছে। ঘর থেকে বের হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে কোন কিছুতে হোঁচট খাওয়ার অর্থ হল, এ মুহূর্তে হোঁচট খাওয়া ব্যক্তিটি তার অন্য মনস্কতার কারণেই হোঁচট খেয়েছে। আর এ অন্য মনস্কতা নিয়ে রাস্তায় বের হলে ঘটে যেতে পারে যে কোন ধরণের অনাকাঙ্খিত ঘটনা। তাই কিছুক্ষণ বসে এই অন্য মনস্কতা কাটানোর পরই রাস্তায় বের হওয়া উত্তম।
জীবন পুনরায় সোফায় এসে বসল। বসার ধরণটায় ফুটে উঠেছে ব্যক্তিত্বের ছাপ। জীবন একটু নড়ে-চড়ে বসল। তাকালো অপূর্বার দিকে। দেখল ওর চোখ দু’টো পানিতে টলমল করছে। চোখের পাতা পড়লেই পানি গড়িয়ে পড়বে কপোলে। অংকিত হবে অশ্র“মালা। নিমিষেই ঘটলোও তাই। জীবন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বলল, অপূর্বা আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানে গলার স্বরও হয়েছে ভারী। স্বর শোনে বোঝাই যাচ্ছিল না যে আমি কিছু সময় পূর্বে কথা বলেছি এই আপনার সাথে।
বহু কষ্টে যেন অপূর্বার মুখ থেকে বাণী নিঃসৃত হল। সে বলল, আপনি কি এখনই চলে যাবেন? কথাটি বলেই চোখের জল বাঁধ ভেঙে আসছে তার। স্পষ্ট কিছু দেখতে পারছে না চোখে। হাত দিয়ে চোখ দু’টোকে আলতো করে মুছে জলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে ভালোভাবে তাকালো জীবনের দিকে। এ কি সত্যি! জীবনের চোখেও জলের হালকা আভাস!
এরপর কিছু সময় নিঃশব্দ শ্রাবণ বয়ে গেল অপূর্বার চোখে। সে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে তা সংবরণের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শ্রাবণের বৃষ্টি ঠেকায়, এমন সাধ্য কার।
জীবন আরো একটু সামনে এগুলো। স্বল্প ব্যবধানে দাঁড়িয়ে ওরা দু’ জন। নিঃশব্দ অবস্থান। নীরবতা ভেঙে অপূর্বা বলল, আমাদের সম্বোধনটা কি দূরত্ব কমিয়ে ‘তুমি’তে আনা যায় না?
জীবন শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়, কেন যাবে না। তবে আজ নয়, অন্যদিন। জীবন পকেট থেকে রুমাল বের করে দিয়ে অপূর্বাকে চোখ মুছে নিতে বলল। অপূর্বা চোখ মুছে নিল। এর মিনিট দু’য়েক পর আলো আসলো। ভেতরে মাকে সাহায্য করতে কিছুটা ব্যস্ততায় সময় কাটলো তার। এসেই সে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। অপূর্বাকে বলল, বড্ড দেরি হয়ে গেল রে!
অপূর্বার কাছ থেকে কোন জবাব এলো না। শুধু আলোর দিকে এক নজর চোখ তুলে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। আলোর কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হলো অপূর্বাকে। ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বলল, শরীর খারাপ করছে না কি অপূর্বা?
অপূর্বা কোন কথা বলে না। আলোর মুখের দিকে চেয়ে শুধু মাথা নেড়ে না-বোধক জবাব দেয়। জীবন উঠে দাঁড়ালো। বলল, চললাম।
আলো জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। এরপর জীবনের দিকে চোখ তুলে বলল, আকাশটা আরেকটু ফর্সা হয়ে নিক। তারপর বের হলে হয় না?
জীবন মাথা নেড়ে বলল, আর বিলম্ব করা চলে না। আকাশ ফর্সা হওয়ার কোন সম্ভবনা দেখছি না। বরঞ্চ ঝড় না আসতেই যদি বাসায় পৌঁছা যায়, সেটিকে পরম সৌভাগ্য না বলাটা হবে সৃষ্টিকর্তার দয়ার প্রতি চরম অকৃতজ্ঞতা।
আলোর মনটা বেশ ভারী হয়ে উঠলো। সে আশা করেছিল আজ বেড়াতে বের হলে তার হৃদয়ের কথাগুলো প্রকাশ করবে জীবনের কাছে। কিন্তু তা পড়ল পাথর চাপায়। গম্ভীর মুখে সে দরজা পর্যন্ত এগুলো জীবনের সাথে সাথে। সঙ্গে অগ্রসর হল অপূর্বাও। আলো উন্নত দৃষ্টি অবনত করে জীবনকে বলল, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল। আজ তো আর হলো না। আবার কবে আসবেন জীবন ভাই?
জীবনের কাছ থেকে অসম্পূর্ণ জবাব এলো। বলল, ‘আসবো, সময় পেলেই আসবো’- এই বলেই জীবন সামনে পা বাড়াল। অপূর্বা আলোর কাছে এসে ওর পিঠে হাত দিতেই আলো কেমন যেন চমকে উঠল। আলোর অন্য মনস্কতা সহজেই টের পেল অপূর্বা। কিন্তু দু’ জনের কেউ এখনো বুঝে উঠতে পারেনি একে অন্যের হৃদয়ের ব্যাকুলতা।
জীবন কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। দৃষ্টিতে তার অনেক চাওয়া, বোঝাই যাচ্ছে তা। কিন্তু এ চাওয়া কার কাছে? অপূর্বা আর আলো ওরা দু’ জন নিজেদের মতো করেই ভেবে নেয়। এরপর আর পেছনে তাকায় না জীবন। দৃষ্টিটা ফিরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে সে।
(চলবে)
বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন: এক জীবনের গল্প