সর্বশেষ লেখাসমূহ:
এক জীবনের গল্প (পর্ব-৫)

এক জীবনের গল্প (পর্ব-৫)

Print Friendly, PDF & Email

আমিনুল ইসলাম মামুন

জীবনের অনার্স ফাইনাল হয়ে গেছে বেশ কিছুদিন হলো ; হলো আলোর পরীক্ষাও। দিন কুড়ি হল আলো জীবনকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিল অপূর্বাদের বাসায়। হঠাৎ গিয়েছিল তারা; না জানিয়েই। আলো বলেছিল বেড়াতে বেরুবে। কিন্তু কোথায় তা বলতে না বলতেই জীবন বলল, তাহলে চল, অপূর্বাদের বাসায় ঘুরে আসি কি বলিস।
আলো মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। ক্ষণিকের মধ্যে বেরিয়ে পড়ল দু’জনে।

পড়ন্ত বিকেল। দুই দালানের মাঝ দিয়ে বিকেলের রোদ্দুর একটি বিশালাকার কড়ই গাছের পাতার ফাঁক গলে গলে যে স্থানটিতে এসে পড়ল, সে স্থানে এসে থামলো রিক্সাটি। বেশ লাগছিল পতিত আলোর টুকরোগুলো। আলো বেশ কয়েকবার এসেছিল এখানে। রিক্সার ভাড়া চুকিয়ে দেয়ার পর আলো দক্ষিণের পাঁচতলা দালানটিতে প্রবেশ করল। জীবন অনুসরণ করছিল তাকে। স্ব-বৈশিষ্ট অক্ষুণœ তার। অতি শান্ত, নমনীয় সে। কিন্তু চোখ দু’টি তার যেন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় যা কিছুর দিকে সে তাকায়, তার অধিকাংশকেই। আলো কলিংবেল টিপতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল। দরজাটা পুরোপুরি না খুলতেই অপূর্বার মুখটি স্থির হয়ে দেখা দিল জীবন আর আলোর সম্মুখে। নড়চড় নেই, একেবারে পাথুরে মূর্তি যেন। অপূর্বা যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। কি এক অজানা কারণে তার বুকের ভেতর হার্ট-বীটটা বেড়েছে বলে প্রচন্ডভাবে অনুভূত হচ্ছে তার। আলো আরেকটু সামনে এগিয়ে অপূর্বার কাধে হাত দিয়ে বলল, ‘অবিশ্বাস্য মনে হলেও তা নয়। সামনে দাঁড়ানো উনি জীবন ভাই…’। – বলতে বলতে সবাই সামনে পা বাড়িয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।

কথা হচ্ছিলো তিন জনে। এরই মধ্যে এলো এলিনা। সে অপূর্বাদের প্রতিবেশী। থাকে পাশের ফ্ল্যাটে। আলো অপূর্বাদের বাসায় আসা-যাওয়ার সুবাদে তার সাথে এলিনার পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে সম্পর্কটা গড়িয়ে এখন বন্ধুত্বে। তাদের সম্পর্কে বোঝা যায় না এলিনা আলো আর অপূর্বার প্রায় দু’ বছরের বড়। এলিনা এসে ক্ষণিক বসলো। এরপর কথা বলতে বলতে আলো আর এলিনা বেরিয়ে গেল এলিনাদের বাসার দিকে। তাদের প্রস্থানের পর যেন জীবন আর অপূর্বা কথার খেই হারিয়ে ফেলল। নিঃশব্দ কক্ষে তখনি প্রবেশ করল অপূর্বার মা। জীবন দাঁড়িয়ে সালাম দিয়েই জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
অপূর্বার মা জবাব না দিতেই অপূর্বা জীবনকে পরিচয় করিয়ে দিল। পরিচয় পেয়ে তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ ভালো। তুমি কেমন আছ?
: জ্বী, বেশ ভালো। – জীবন শান্ত স্বরে বলল।

অপূর্বার মা বসল। বসল জীবনও। মিনিট দু’য়েক কথা বলে উঠলেন তিনি। অপূর্বাকে বললেন, ভেতরে এসো।
অপূর্বার মুখটায় হঠাৎ যেন অন্ধকার নেমে এলো। অপরাধীর ন্যায় মায়ের পেছন পেছন অগ্রসর হলো সে। একবার পেছন ফিরে তাকাতে চেয়েছিল। কিন্তু চেয়েও তা পারেনি। নিজের কাছেই হেরে গেল সে।

জীবন একা বসে আছে। চোখ বুলাচ্ছে সে পুরোটা কক্ষের মধ্যে। কক্ষে অনেকটা প্রাকৃতিক পরিবেশ বিরাজ করছে। কয়েকটি ফুলের টব আর প্রতিটি জানালার গ্রীল পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে সবুজ মানি প্লান্ট। স্বাস্থ্যকর শীতল পরিবেশ ঘরটির মধ্যে বিরাজমান। পশ্চিমের জানালা দিয়ে মানি প্ল্যান্টের পাতাগুলো কাঁপিয়ে শিরশির করে ঘরে প্রবেশ করছে মৃদু বাতাস। জীবন কিছুক্ষণ পরিবেশটা উপভোগ করল হ্রদয়ের চোখ দিয়ে। এরপর আবার সেই নিঃশব্দে একাকী বসে থাকা।

একটু পরেই এলো অপূর্বা। কিছুক্ষণ পূর্বে মুখের ওপরে চেপে বসা কালচে মেখ খন্ডটি এখন আর নেই। বাতাস যেন উড়িয়ে নিয়েছে তা কোন এক অজানা গন্তব্যে। হাতে তার একটা বড় ট্রে। তাতে রয়েছে আপ্যায়নের উপাদান। ট্রে-খানা টেবিলের ওপর রেখে আবার বসল অপূর্বা। বলল, যখন মা এলেন, ততক্ষণেও আপনার পরিচয়টা তাকে জানিয়ে আসিনি বলে আমাকে হালকা বকেছেন।
: আপনার মা বকতে পারেন বলে তো আমার মনে হয় না।
: বকা বলতে-‘শুধু ডাঙ্গর হচ্ছিস, বুদ্ধি-শুদ্ধিতো কিছুই হলো না’- এই যা।
: সেই ডাঙ্গর মেয়েটা যার সামনে বসে আছে তার সম্পর্কে নিশ্চয়ই তার প্রাপ্য বিরূপ মন্তব্য করতে দ্বিধা করেনি।
: মন্তব্য করেছেন তো বটেই। তবে বিরূপ কি না জানি না। তা হলো, “ছেলেটা সামাজিক। করে কি ও?’’ আমি বললাম, ভার্সিটিতে পড়ে। মনে হলো মা তেমন খুশি হতে পারেন নি।
জীবন হাসল। বলল, কি বললে খুশি হতেন?
: হয়তো যদি বলতাম, সবেমাত্র ভার্সিটি শেষ করেছে।
কথাটি বলার পর অপূর্বার চোখ দু’টি যেন লজ্জায় কিছুটা ভারী হয়ে উঠল। জীবন প্রসঙ্গ পাল্টাল। বলল, ‘দেখলে, আলো এখনো এলো না। যাওয়ার সময়টা হয়ে এলো’।
: আসুক না, বিলম্বে ফিরলে অসুবিধাতো নেই। নাকি?
: তা নেই।
: ও আসুক। আপনি আমাদের বাসাটা ঘুরে দেখুন।
জীবন বলল, না তার দরকার কি? তাছাড়া আমিতো শুধু আপনারই পরিচিত- সবারতো নয়। কে কি ভেবে বসে কে জানে।
: আমাদের বাসায় অতসব ভাববার মতো কেউ নেই। বাবা-মা, আমি আর ছোট ভাই। বড় দুই ভাই থাকেন দেশের বাইরে। বড় বোন স্বামীর বাড়ি। আর এ মুহূর্তে শুধু আমি, আপনি, মা আর কাজের মেয়ে।
জীবন সরাসরি না করতে পারছে না। এটি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধ হলেও এর পেছনে রয়েছে অপূর্বার অব্যক্ত উদ্দেশ্য। পূনরায় সে এমন করে বলল যে জীবন না করবার ইচ্ছাটুকু যেন হারিয়ে ফেলছে। তবুও সে বলল, ‘কিন্তু …।
অপূর্বা জীবনকে আর বলতে না দিয়ে বলল, বলেছিতো কোন সমস্যা নেই। যাকে অন্তরে বয়ে চলেছি সর্বক্ষণ তাকে অন্দরে নিলে কোন সমস্যা যদি হয়ও তা ম্যানেজ করার ক্ষমতা কি একেবারেই নেই?
কথাটা বলার পর অপূর্বা থমকে গেল নিজে নিজেই। ভাবলো, কথাটা এভাবে বলা বোধ হয় ঠিক হয়নি। কিভাবে যে বলে ফেললাম! আবার নিজেকে নিজেই বুঝালো, মিথ্যে বলা যদি অন্যায় হয়, তাহলে সত্য গোপন করাও মিথ্যার সামিল এবং তাও অন্যায়।

জীবন উঠে দাঁড়ালো। অপূর্বার চোখে চোখ রেখে স্থির ছিল কিছুটা সময়। অপূর্বার চোখ দু’টি যেন লাজের ভারে নুয়ে আসছে। জীবনের চোখ থেকে নিজের চোখ দু’টি নামিয়ে সে সামনের দিকে পা বাড়ালো। সঙ্গে পা বাড়ালো জীবনও। ড্রইং রুমটির মতো ভেতরের রুমগুলোও বেশ গুছানো। দেয়ালের গায়ে ঝুলানো রয়েছে কুটির শিল্পের নানান জিনিস। বারান্দায় রয়েছে ঝুলন্ত বেশ কয়েকটি ফুলের টব। টবগুলোতে ফুল ফুটে আছে। হাল্কা ঘ্রাণও নাকে এসে লাগে। দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে আসে। সবশেষে অপূর্বা এসে প্রবেশ করল তার কক্ষে। সামনে এগিয়ে এক পায়ের উপর আরেক পা ঝুলিয়ে খাটের উপর বসল সে। এরপর বসল জীবনও। বসার পর জীবনের চোখে পড়ল সামনের টেবিলটির ওপর। এটি অপূর্বার পড়ার টেবিল। চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে হকচকিয়ে ওঠল। খাট থেকে নেমে সামনে এগুলো সে। জীবনকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারাটা ঘর দেখানোর অপূর্বার মূল উদ্দেশ্য ছিল মূলত: এটি। অপূর্বাও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। জীবন দেখলো টেবিলের কিছু ওপরে দেয়ালের গায়ে লাগানো রয়েছে সেদিনের বৈশাখ নিয়ে লেখা পংক্তিগুলো। কম্পিউটারে কম্পোজ করা। যে লিখেছে তার নাম নেই। পাশে রয়েছে দু’টি রজনীগন্ধার স্টিক দাঁড় করানো। নিচে পড়ে আছে তিন চারটি শুকনো গোলাপ। জীবন জিঙ্গাসু ভঙ্গিতে অপূর্বার দিকে তাকাতেই সে বলল, ‘স্বপ্নকে লালন করা কি অপরাধ?’
জীবন বলল, তা নয়। কিন্তু পংক্তিগুলোর সারার্থানুযায়ী সেখানেতো গাঁথা আছে অন্য কারো স্বপ্ন।
অপূর্বা জীবনের খুবই নিকটে এসে দাঁড়ালো। বলল, সে স্বপ্নে কি কোন নারী জড়িত নেই? আর সেই নারী কি এ মুহুর্তে আপনা হতে অতি দূরে?
জীবন এ কথার কোন জবাব সরাসরি দেয়ার চেষ্টা করলো না। একটু ভাল করে তাকাতেই সে লক্ষ্য করল তার হাফ শার্ট পরা নগ্ন বাহুটিকে স্পর্শ করে আছে আরেকটি নগ্ন বাহু। অপূর্বা তার নরোম বাহুটি সরিয়ে নিয়ে কিছুটা দূরে সরে এক পলক জীবনের চোখের দিকে তাকিয়ে আবার ফিরিয়ে নেয় দৃষ্টি। কিছুটা সময় নিঃশব্দে কাটায় দু’ জনে। এরপর নীরবতা ভেঙ্গে জীবন বলল, আপনি সেদিন কি বলেছিলেন স্বরণ আছে? অপূর্বা ফিসফিস শব্দে বলল, কি বলেছিলাম?
: বলেছিলেন আমাদের সম্পর্কটা আপনি থেকে নামিয়ে ‘তুমি’তে আনা যায় কিনা।
: আর আপনি তো বলেছিলেন অন্য দিনের কথা।
: সেই দিনটি যদি হয় আজ?
অপূর্বা আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠল। তার চোখ-মুখ জুড়ে খেলে যাচ্ছে লজ্জার উত্তাল ঢেউ। তবুও যেন বাঁধ ভাঙ্গা আবেগ কোন বাধা মানতে চায় না। সে দূরত্ব কমিয়ে জীবনের অতি নিকটে এসে দাঁড়ায়। জীবন অপূর্বার হাত দু’টি নিজ হাতে তুলে নিয়ে চুম্বন এঁটে দিয়ে বলে, তোমার কোমল দু’টি হাত স্বর্গ হতে তৈরী যেন।
এরপর অপূর্বা চোখের ইশারায় জীবনকে বলল, তার উন্নত শিরটি অবনত করতে। জীবন মস্তক অবনত করতেই অপূর্বা এঁটে দেয় দু’টি চুম্বন ; কপোল ও কপালে। এরপর সে বলল, একই স্বর্গে হবে বাস তোমার আর আমার।
বেশ কিছুট সময় গড়িয়ে গেল দু’ জনের কথোপকথনে। এরপর তারা এসে বসল ড্রইং রুমের পূর্বস্থানে। ক্ষণিক পরেই কলিং বেল বাজল। আলো এসেছে। সঙ্গে এলিনাও। একত্রে বসল সবাই। কথা বলতে বলতে আপ্যায়নও গ্রহণ করছিল তারা। আলো অপূর্বার বেশ কিছুটা দূরে বসেছিল। এবার সে উঠে এসে বসল অপূর্বার গা ঘেঁষে। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে অপূর্বাকে ফিসফিস করে কি যেন বলল, তা জীবন আর এলিনা দু’ জনের কেউ বুঝল না। একটু পরেই দু’জন উঠে ভেতরের রুমের দিকে গেল। জীবন আর এলিনা দু’জন বসে কথা বলছিল।

অপূর্বার রুমে গিয়ে দাঁড়াল দু’ জনে। যে কথা আলো এতোটা দিন বলতে চেয়েছিল জীবনকে, বলতে গিয়ে গলায় বেধে গিয়েছিল বারবার, আজ সে কথা সে বলতে চায় জীবনকে, অপরের কণ্ঠে। কিন্তু একথা বলতে তার মতো অপূর্বার গন্ডদেশেও যে পড়তে পারে বাধা তা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে আলো। তবুও সে অপূর্বাকে বলবে বলে ঠিক করে। এ শুধু যে জীবনকে বলার জন্য তা নয়, জীবন আর অপূর্বা উভয়ের সম্পর্কের এক পাশ হতে শেকল দিয়ে টেনে ধরাও আরেকটি উদ্দেশ্য। অপূর্বাকে বলতে গিয়ে থেমে যায় সে, যখন তার দৃষ্টি পড়ে জীবনের টেবিলের ওপরের দিকে দেয়ালে সাঁটা জীবনের সেদিনের সেই পংক্তিগুলো ওপর। তদুপরি তার পাশে রয়েছে ঘ্রাণ ছড়ানো ফুল।
অপূর্বা বলল, ওটা জীবন ভাইয়ের সেদিনের লেখা পংক্তিগুলো। তুই কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেলি বল।
আলোর বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। কষ্ট এসে চেপে ধরে তার কণ্ঠ। চোখ থেকে বেরুতে চায় অশ্রু। কিন্তু নিজেকে সামলে নেয়। গলায় কিছুটা ব্যথা অনুভব করে সে। মুখে একটু কৃত্রিম হাসি এনে আলো বলল, অনেক কথা। বাসায় আসবি। এখন আসলে সময় নেই। তখন সব খুলে বলবো।

অপূর্বা লক্ষ্য করল আলোর কথাগুলো ভাঙ্গা ভাঙ্গা, অস্বাভাবিক। আলোর কথায় সে মাথা নেড়ে সায় দিল। এরপর আলোর কাঁধে হাত বাড়াল অপূর্বা। আলোর হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, চলি, সময় করে বাসায় আসবি।
অপূর্বার কাছে ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে মনে হলো না। সে আলোর পেছন পেছন অগ্রসর হল। ওরা দু’জন সামনের রুমে আসতেই জীবন দাঁড়িয়ে বলল, অপূর্বা, আজ তাহলে উঠবো।
এরপর চোখে ইশারা করতেই অপূর্বা বলল, মা’র হাই প্রেশার আছে। মাথা ঘোরাচ্ছে তাই শুয়ে আছেন।

ক্ষণিকের মধ্যে দু’জনের চোখে চোখে হয়ে গেল কিছু কথা। ফলে মুখ খুলে আর বিদায় নিতে হলো না। এম্নিতেই বেরিয়ে পড়ল আলো আর জীবন। দশ-বারো পা সামনে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দৃষ্টি ফিরায় জীবন। দেখে, অপূর্বা আর এলিনা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অপূর্বা স্মিত হাসি হেসে হাত নাড়ালো। জীবন মৃদু হাসি হেসে এর জবাব দিয়ে এগুতে লাগল। তাদের এ বিদায়ী মুহুর্তটা আলো প্রত্যক্ষ করল গভীর ভাবে। তাই বুকের ভেতর কষ্টের তীরটাও বিধেছে ভালো করে। রিক্সায় শুধু পাথরের মতো বসেছিল গন্ত্যব্যে পৌঁছার অপেক্ষায়। এক সময় জীবন জিজ্ঞেস করল, এমন চুপচাপ বসে আছিস কেন?

আলো কোন কথা বলে না। জীবন বলল, আমার একটা আনন্দের সংবাদ দেবো তোকে। তুই শুনলে হয়তো বিশ্বাসই করবি না প্রথমে। পরে অবশ্য…।

আলোর চোখের দিকে তাকাতেই জীবন থেমে গেল। যেন হিমালয় গলে তার নহর বইছে আলোর চোখ দিয়ে। শত চেষ্টা করেও আলো নিজেকে সংবরণ করতে পারেনি। জীবন তাকাতেই সে ওড়নার আচলে মুখ লুকালো। কিন্তু অশ্রুধারা রোধ করতে পারলো না। অল্প সময়ের মধ্যেই ভিজে ওঠে ওড়নার আঁচলও। আলোকে কিছুটা টলতে দেখে জীবন রিক্সার হুডটা তুলে নিল। এরপর আলোকে আগলে নিল বুকের কাছে। আলোর চোখের অশ্রু প্রবাহ যেন ক্রমেই বেড়ে উঠছে। জীবন কারণ জানতে চায়। আলোর মুখ দিয়ে কোন কথা সরে না ; নির্বাক সে। এক সময় সে জলভরা দু’টি চোখ তুলে তাকায় জীবনের মুখের দিকে। কী করুণ অসহায় চোখ দু’টি তার! দেখে খারাপ লাগে জীবনের। জীবন পকেট থেকে রুমাল বের করে আলোর চোখ মুছে দিচ্ছে। আলো মুছতে না দিয়ে জীবনের হাতটি দু’হাতে জড়িয়ে নেয়।

আজকের দিনটা বেশ চমৎকার। আবেগ যেন ছড়িয়ে আছে সারা প্রকৃতিতে। শান্ত নরোম রোদ আর মৃদু বায়ু প্রবাহ এই বিকেলটাকে যেমনি আবেগময় করে তুলেছে, তেমনি আবেগময় করে তুলেছে আলোর মনটাও। বারান্দায় একটি মোড়ার উপর বসে সে বই পড়ছে আর অবলোকন করছে প্রকৃতিকে। অপূর্বা আসার কথা আজ। অথচ তার আসার এখনো কোন নাম-গন্ধ নেই। একটু পর পর সামনের রুমের দরজা খুলে হেঁটে আসে আলো। তারপর আবার এসে বসে বারান্দায়। কোমল বাতাস এসে তাকে ছুঁয়ে যায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আর খোলা চুলগুলোকে দিয়ে যায় মৃদু নাড়ন। সে হারিয়ে যায় দিন কুড়ি আগের সেই স্মৃতিতে সে স্মৃতি আজ পর্যন্ত তার কাছে অতীত জীবনে ঘটে যাওয়া স্মৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। তার স্বপ্নে লালিত প্রিয় মানুষটিকে স্পর্শ করার স্মৃতি, প্রিয় মানুষটি তাকে বুকে আগলে নেয়ার স্মৃতি। ভাবতেই একটা শিহরণ জেগে ওঠে তার রক্ত কণিকায়। স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে এক সময় সে হারিয়ে যায় স্বপ্নের সীমাহীন সমুদ্রে। ঠিক এ সময় ডাক পড়ে ‘আলেয়া’, ‘আলেয়া’ বলে।

আলোর মূল নামটা আলেয়া। কিন্তু সবাই তাকে ডাকে আলো বলে শুধু মা আর বাবা ছাড়া। আলো উঠে যায় মা’র কাছে। মা বললেন, কে যেন এসেছে, দরজাটা খুলে দে।

আলো এগিয়ে গিয়ে দরজাটি খুলে দেয়। দেখে অপূর্বা এসেছে। ভেতরে আসে ওরা। আলোর রুমে বসে কথা বলছে তারা। এ কথা, ও কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। মূল কথায় নয়। বান্ধবী হিসেবে ওরা দু’জন একেবারে পারফেক্ট। একে অপরের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে অতীতে। ভবিষ্যতের কথা বাদ দিলে ওদের মতো বান্ধবী পাওয়া পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।

বেশ কিছু সময় ধরে আলো চুপচাপ বসে থাকে। বুকের ভেতর বহু বছরের লালিত স্বপ্নের কথা এই প্রথম সে কাউকে জানাচ্ছে। অপূর্বাও চুপচাপ। সে বসে আছে আলোর মুখের দিকে চেয়ে। আলো অপূর্বার দিকে চোখ তুলে তাকায়। এরপর ঠোঁট দু’টি নড়ে ওঠল তার। বলল, যে কারণে তোকে আসতে বলেছি সেটি হলো, আমার হয়ে তুই একজনকে কিছু কথা বলতে হবে। আমি বহুবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বলাটা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ওর সাথে এ বিষয়টা বলতে গেলে আমার বুকের ভেতরটায় একটা মোচড় দেয়। শত সাহস সঞ্চয় করেও তখন আর পারি না, কণ্ঠটা স্তব্দ হয়ে আসে। বলতে না পারার যন্ত্রণায় আমার অন্তরটা পুড়ে কয়লা হয়ে যাচ্ছে। পারবি তুই অপূর্বা? – বলতে বলতে আলো অপূর্বার হাত চেপে ধরল।

অপূর্বা হেসে উঠে বলল, এসব তো সাধারণ কথা, সবাই যা বলে – তা।
: আমিও যে সাধারণ। তাই সাধারণ কথাই বলার চেষ্টা করি। তুই কিন্তু প্রশ্নের জবাবটাই দেসনি অপূর্বা।
: এ কোন কাজ হলো না কি। বল তুই ছেলেটা কে?
: ওকে তুই চিনিস। ভার্সিটিতে পড়ে সে। সেই যেদিন থেকে আমি ‘ভালোলাগা’, ‘ভালোবাসা’ শব্দ দু’টির অর্থ বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকেই তাকে আমি ভালোবাসি। বলতে পারিস তার সংস্পর্শই আমাকে শব্দ দু’টির অর্থ বুঝতে সহায়তা করেছে। কিন্তু এত বছরেও …।
অপূর্বা মুখের দিকে তাকাতেই থেমে গেল আলো। অপূর্বার হাসি মাখা মুখটি ভরে এলো মলিনতায়। আলোকে থামতে দেখে বলল, ছেলেটি কে শুনি?
: জীবন।
: অপূর্বার মলিন মুখটায় একটা অসহায় ভাব ফুটে ওঠল। এ যেন কপোত হারা এক নিঃসঙ্গ কপোতী তার অসহায়ত্বের ভারে ন্যূজ্ব। আলো একটিবারও ভেবে দেখলো না জীবনের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারিত সেই শব্দ কতটা বেদনা নিয়ে তীরের বেগে বিদ্ধ হতে পারে অপূর্বার অন্তরে। কতটা রক্তক্ষরণ হতে পারে তার হ্রদয়ের প্রান্তরে।

আলো অপূর্বাকে এমন করে বসে থাকতে দেখে বলল, আমারও যে কোন উপায় নেই অপূর্বা। তোর আর আমার মাঝে এতোই মিল যে নিজেদের অজান্তেও আমরা মিলিত হয়েছি একই বিন্দুতে।

অপূর্বার চোখ কোন বাঁধ মানলো না। নিজেকে সামলে রাখতে চেষ্টা করলো। কিন্তু এ যেন উত্তাল নদীতে বাঁধ দেয়ার মতোই বৃথা চেষ্টা। এভাবে অনেকটা সময় পার করে দেয় অপূর্বা। আলোও কোন কথা বলে না। সেও আধো কান্না মুখে বসেছিল এতোক্ষণ। একটু পর তার চোখ থেকেও অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল।

আলো চোখের জল ঝরিয়ে যেন কিছুটা হালকা হল। কিন্তু হালকা হতে পারেনি অপূর্বা। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে চলেছে সে। আলো চোখ মুছে অপূর্বার চিবুক স্পর্শ করে বলল, আমার ও যে কিছু করার নেই রে অপূর্বা! তোর যন্ত্রনা যে আমি বুঝি না, তা কিন্তু নয়। কিন্তু আমার ভেতর যে ভালবাসার বৃক্ষটাকে আমি লালন করতে করতে এতোটুকু সময় পার করে এসেছি, সে আজ ডালপালা গজিয়ে হয়েছে অনেক বিশাল। ইচ্ছা করলেই যে আমি তাকে হ্রদয়ের জমিন থেকে সমূলে উপড়ে ফেলতে পারছি না। আর যদি এমনটি কখনো করতেই হয়, তাহলে তার পূর্বে স্রষ্টার কাছে আমি আমার কবর প্রার্থণা করবো। এ ছাড়া আমার আর কোন গত্যন্তর থাকবে না।

অপূর্বার চোখ দু’টি হঠাৎ কেমন যেন ঝলসে উঠল। চট্ করে সে আলোর গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। আলো চুপ হয়ে বসে রইল, যেন চড়টা পড়েছে কোন জড় পদার্থের গায়। ক্ষণিক পর অপূর্বা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তোর মতো আমার পক্ষেও যে জীবনকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু তোর জন্য আমি তাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করবো। তোর কাছে শুধু একটা অনুরোধ, তুই তোর হয়ে আমাকে জীবনের কাছে যেতে বলিস না। এ আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব আলো, একেবারেই অসম্ভব।

বলতে বলতে অপূর্বার চোখ আবার জলে ভরে এলো। অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে এক সময় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। আলো অস্তির হয়ে উঠলো। বালিশের ওপর থেকে তোয়ালেটা নিয়ে চোখ দু’টি মুছে মাকে ডাকলো। তিনি দৌড়ে এলেন। মাথায় পানি দিলেন, ভেজা গামছা দিয়ে মুখ মুছে দিলেন। কিছু সময় পর তার জ্ঞান ফিরে এলো।

আলোর মা তখন কোন কারণ জানতে চান নি কারো কাছ থেকে। অপূর্বা যখন পুরোপুরি সুস্থ বোধ করল, তখন সে বাসায় ফিরে গেল। পরে তিনি আলেয়ার কাছ থেকে এ বিষয়ে অবগত হলেন। তিনি শুধু শোনলেন। ‘এ বিষয়ে আর যেন কেউ কিছু না জানে’- এই বলে আলেয়াকে সাবধান করা ছাড়া আর কিছুই বলেননি।

(চলবে)

বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন: এক জীবনের গল্প

সর্বমোট পঠিত: 562

সর্বশেষ সম্পাদনা: জানুয়ারি ২৩, ২০২১ at ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ

প্রিজম আইটি: ওয়েবসাইট ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট-এর জন্য যোগাযোগ করুন- ০১৬৭৩৬৩৬৭৫৭