জহির রহমান
রাজুর পকেটে থাকা ফোনটি বেজে উঠল। হাতে নিয়ে দেখল ইকবাল ফোন করেছে। ফোনটি রিসিভ করে কুশল বিনিময় করে ইকবালের সাথে। কথার এক পর্যায়ে ইকবাল জানতে চায় কথা’র কথা। কথা’র সাথে কী যোগাযোগ আছে? ‘না, নাই’- জবাব দিল রাজু। পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘আপনার সাথে হয় না?’। ‘হয়েছে অনেক আগে। এখন ফোন বন্ধ। এর আগে ফোন দিলেও ধরেনি’। জানালো ইকবাল। একটু থেমে আবার বলল, ‘তার না অপারেশন হওয়ার কথা ছিল?’। ‘হ্যাঁ আমাকে তো সেটাই জানালো অনেক আগে। অপারেশন নাকি হয়েছিল। আমার মনে হয় ও একটা মিথ্যাবাদী। মিথ্যা বলেছে আমাদের সাথে’ বলল রাজু। ‘হতে পারে।’ সায় দিল ইকবাল। ‘ওকে, পরে কথা হবে’- বলল রাজু। ‘আচ্ছা’- ইকবাল উত্তর দিল। কথা বলতে বলতে ছাদে চলে এসেছে রাজু। পায়ের জুতা খুলে জুতাতেই বসে পড়লো সে।
ফেসবুকে রিকোয়েস্ট আসা ‘মেহেদী পাতা’ আইডিতে চোখ আটকে যায় আহমেদ রাজুর। যথারীতি তার প্রোফাইল দেখে একসেপ্ট করে নেয়। রাজু সদ্য বিবিএ সম্পন্ন করে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করছে। সাধারণত চ্যাটে খুব কম কথা বলে রাজু। তবুও কেন যেন তাকে মেসেজ করে রাজু। রিপ্লাই আসে। চ্যাটে কথা চলতে থাকে কিছুক্ষণ। আলাপচারিতায় জানায় মেয়েটির নাম কথা। পুরো নাম স্বীকৃতি আহাদ কথা। এবার ইন্টারমিডিয়েটে উঠল। চলতে থাকে তাদের খোশগল্প।
– ‘একটা কথা জানতে পারি?’ বলল রাজু।
– ‘কি কথা?’ জানতে চাইলো কথা।
– ‘তোমার মনে কিসের এত কষ্ট?’ প্রশ্ন করল রাজু।
– ‘কই না তো! আমার মনে কোন কষ্ট নাই।’ বলল কথা।
– ‘মেহেদী পাতা কিন্তু দেখতে সবুজ, সুন্দর লাগে দেখতে। কিন্তু তার ভেতরে বসত করে রক্তবর্ণ। তোমারও সেরকম কোন কাহিনী আছে বলে আমার মনে হয়।’ রাজু বলল।
– ‘না আমার সেরকম কোন ব্যাপার নাই। আমি সুখী একটা মানুষ।’ জানাল কথা।
– ‘ওকে, বলতে না চাইলে থাক।’ বলল রাজু।
– ‘আচ্ছা, একজন মানুষ কতটি ঘুমের ঔষধ একত্রে খেলে মারা যায় বলেন তো?’ জানতে চায় কথা।
– ‘বলবো, তবে তুমি আগে আমাকে জানাতে হবে তোমার কষ্টের কারণ।’ জানালো রাজু।
– ‘না, এমনি জেনে রাখলাম।’ প্রতিউত্তরে জানালো কথা।
অনেক জোরাজুরির পরে যেটা জানা গেল তা হলো, জন্মের সময় তার মা মারা যায়। বাবা আগলে রেখে মানুষ করছেন। সে ভাই-ভাবীদের সাথে থাকে। বাবা ঢাকাতে একটি বেসরকারি কোম্পানীতে চাকুরি করেন। এছাড়াও যে ব্যাপারটা রাজুকে আরো বেশি ইমোশনাল করেছে তা হলো- মেয়েটির দুটি কিডনিই ড্যামেজ। কিডনী পাচ্ছে না। পেলেও গ্রুপ মিলছে না। চেষ্টা করে যাচ্ছে সবাই। ক্রমেই ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ছে। বাঁচার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়েছে। আর এই ব্যাপারগুলো সে জেনেছে কিছুদিন আগে। রাজু তাকে সাহস দিল। আশ্বাস দিল, ইনশা আল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে। আত্মবিশ্বাস বাড়াতে বলল। কিডনিও ম্যানেজ হয়ে যাবে। এত ঘাবড়ে যাওয়ার কিচ্ছু হয়নি।
কথা আরো জানালো তার মায়ের শেষ স্মৃতিটুকুও আজ তার কাছ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। মায়ের গলার চেইনটি একজনকে দিয়ে কিছু টাকা নিয়েছিল সে। আজ টাকা না দিতে পারলে চেইনটি আর ফেরত পাওয়া যাবে না। কত টাকা জেনে রাজু তাকে ঋণ দিতে রাজি হলো। কথাও তাকে মোবাইল নাম্বার দিয়ে দিল, জানিয়ে দিল এই নাম্বারে টাকা পাঠিয়ে দিতে। তার অসুখের কথা আর ঋণ নেওয়া টাকার কথা ইকবালসহ কাউকে জানাতে বারণ করে দেয়।
তারপর রাজু শর্তমত তাকে জানিয়ে দিল কতটি ঘুমের ঔষুধ খেলে একটা মানুষ মারা যায়।
ধীরে ধীরে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। কথা তার অসহায়তার কথা বললে রাজু তাকে সান্ত¦না দেয়। বেঁচে থাকার উৎসাহ দেয়। মলিন হয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নকে আবারো জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে। মৃত ভালোবাসাকে জীবিত করার প্রচেষ্টা চালায়। বেঁচে থাকার জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়। ভালো থাকার জন্য যতটুকু সাপোর্ট করা দরকার সাধ্যমত তাই করে যাচ্ছে। একটা মানুষ আর কিছুদিন বেঁচে আছে, এটা ভাবতেই শিহরিত হয়ে উঠে রাজু। রাজুর প্রচেষ্টা ফল দিতে শুরু করে। ধীরে ধীরে মানসিকতার পরিবর্তন হয় কথার। স্বপ্নগুলো আবার প্রাণ পেতে শুরু করে। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জাগে। আবারো স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে থাকে। এতে ভালো লাগা কাজ করে রাজুর মনে। যাক্, মরার আগেই মরে যেতে চাওয়া একজনকে তো সজীবতায় ফিরাতে পারছি! যে কয়দিন বেঁচে থাকে হাসিখুশি ভাবে বেঁচে থাকুক! তাকে এ অবস্থায় ফেরাতে রাজু তার সাথে ভালোবাসার অভিনয়ও শুরু করে। কথা একদিন জানায় সে ইকবালকে ভালোবাসে। কিন্তু তাকে বলতে পারছে না। পরে রাজুই ইকবালকে বলে দিলো কথা তাকে ভালোবাসে। কিন্তু ইকবাল কথাকে তা জিজ্ঞেস করলে সে তা অস্বীকার করে। অস্বীকার করলেও কিছুদিনে তারা জড়িয়ে পড়ে ভালোবাসার মায়ায়। রাজু হয়ে যায় ভালো বন্ধু। এমনই বন্ধু, যে বিয়ে করে দাম্পত্য জীবনের স্বাদ বা ইচ্ছেও পূরণ করতে রাজি ছিল। কথা’র ভালোবাসাও বারবার দিক পরিবর্তন করতে থাকে। কিছু সময় রাজুর দিকে আবার কিছু সময় ইকবালের দিকে। ইকবালও একসময় জেনে যায় কথা’র অসুখের কথা। ইকবালও করুণা করা শুরু করে তার প্রতি। হতাশ হয়ে বারবার ফিরে আসে রাজুর দিকে। আর প্রায়ই ভিন্ন বাহানা দিয়ে টাকা নিতো রাজুর কাছ থেকে। রাজুও টাকা ফেরত চায়নি তার কাছে কখনো। কেননা জানে সে কখনো টাকাগুলো ফেরত দিতে পারবে না, সে সামর্থ্য তার নেই। শেষের দিকে রাজু টাকা দিতে রাজি হয়নি। এজন্য রাজুকে জানিয়ে দেয়, আমি ইকবালকে ভালোবাসি। তোমাকে আর আমার দরকার নেই। এড়িয়ে চলতে থাকে রাজুকে। রাজুও অভিনয় করতে করতে কখন যে তার প্রতি অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে তা বুঝতে পারে। বুকের বাম পাশটায় আঁৎকে উঠে। কষ্ট হয়, তবুও সে মন খারাপ করে না, আমি তো চেয়েছিলাম সে প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক। হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নকে আবারো আঁকড়ে ধরুক, বাঁচুক। সে তাই তো করছে! তবুও কথা দিয়েছিল রাজুর সাথে যোগাযোগ রাখবে। তার পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলার অসংখ্যা চেষ্টা করেছে সে, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি।
ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দেওয়া যন্ত্রণাগুলো হাসি মুখে সহ্য করে যায় রাজু। শুধু মানবিক কারণে। অসংখ্য মিথ্যা বলেছে কথা, যেটা রাজু বুঝতে পেরেও কিছু বলেনি মানবিক কারণে। হোস্টেল থেকে বাড়ি ফেরার টাকা না থাকা, অথবা জেদ করে বাড়ি থেকে ঔষুধ নিয়ে না আসা কিংবা ঔষুধ কেনার টাকাও না আনা ইত্যাদি। তার বাবা যেদিন মারা যায় সেদিন সকালেও রাজুকে কথা জানালো, এ সপ্তাহে বাড়িতে একটি বিয়ে আছে এজন্য হোস্টেলে যাওয়া হবে না। দুপুরের দিকে রাজুকে মেসেজ পাঠালো, ‘আমার বাবাও আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমার আর কেহই রইল না। আমি কলেজে, বাসায় যাবো ভাড়া নাই, পাঁচশত টাকা দাও।’ রাজু জানতে চাইলো, ‘তুমি তো কলেজে আসার কথা না! তুমি কলেজে আসছো কেন?’ কথা জানালো, ‘একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাশ ছিল বলে আসছি, ভাবলাম ক্লাশ করে চলে যাবো।’ রাজু বললো, ‘তুমি ক্লাশ করে চলে যাবে তবে তুমি বাসা থেকে ভাড়া নিয়ে আসোনি কেন?’ এর কোন সদুত্তর দিতে পারেনি কথা। তবুও মানবিকতা চিন্তা করে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেয় রাজু। এরকম মিথ্যে একের পর এক বলতে থাকে কথা।
দীর্ঘদিন পর রাজুকে মেসেজ করলো। জানালো দু’দিন পরে তার অপারেশন। অপারেশন হচ্ছে মাদ্রাজে। অপারেশন শেষে দেশে এসে রাজুর সাথে কথা বলবে। রাজু তার ব্যবহৃত মোবাইল নাম্বার চাইলে কথা জানালো অপারেশন শেষে দেশে ফিরলে নাম্বার দিবে। প্রায়ই কথার নাম্বারে চেষ্টা করলে বন্ধ পায়। একদিন ফোন ঢুকলেও ফোন রিসিভ করেনি কথা! এখন আর চেষ্টাও করে না সে। সে থাকুক তার মত করে। যখন তার পাশে থাকার দরকার ছিল তখন তো ছিলাম! এখন তো তার সবই আছে, আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে তো অনেক আগেই! ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোণায় অশ্রু জমা হয়েছে তা খেয়াল করেনি রাজু। তর্জনী দিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় সে। তারপর দৃষ্টি দেয় দূরে। রাস্তার পাশে একাকি জ্বলতে থাকা ল্যাম্পপোস্টের দিকে। মনের অজান্তে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে রাজুর।