মেহেদী সম্রাট
জমির শেখ কানের কাছে রেডিও নিয়ে বসে আছে। অবস্থান অচিন্তপুর জঙ্গল। গত তিনদিন ধরে সে রহস্যময় আচরণ করছে। দিন নেই রাত নেই, খাওয়া-দাওয়ারও ঠিক নেই। সারাক্ষণ শুধু কানের কাছে রেডিও নিয়ে বসে থাকে। দুনিয়ায় তার যেন আর কোন কাজকর্ম নেই আকাশবাণীর গান শোনা ছাড়া।
জমির শেখের এই অদ্ভুত আচরণে অন্য নয়জনের মত দবির উদ্দিনও মহাবিরক্ত। তারা নিজেদের মধ্য কানাঘুসা করতে থাকে। ‘জমির ভাই কি পাগল-টাগল হইয়া গেল নাকি! দায়িত্ব ও কাজের কথা মনে হয় ভূইল্লাই গ্যাছে। কথা নাই বার্তা নাই, দিনরাত আকাশ বাণীর গান শোনে’। এরকম আরো নানান আলাপচারিতা হয় দবিরউদ্দিনসহ অন্যান্যদের মধ্যে। কিন্তু এসব কথার কিছুই জমির শেখের কানে পৌঁছায় না। এ নিয়ে তাকে কেউ প্রশ্ন করতেও যায় না। শুধু নীরবে দেখতে থাকে।
কোন কাজের মধ্যে থাকলে সময় যেমন তাড়াতাড়ি বয়ে যায়, ঠিক তেমনি কাজহীন অলসতায় সময় যেন চলতেই চায় না। ঠিক যেন ঐ গানটার মত, ‘কাটে না সময় যেন আর কিছুতেই’। দবির উদ্দিনদেরও হল সেই দশা। জমির শেখ কিছু না বলা পর্যন্ত কারো তেমন কোন কাজ নেই। কাজ শুধু ঘড়ির কাঁটা মেপে চলা। ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাটা ষাটবার লাফ দিতেও যেন যুগযুগ সময় নেয়।
একসময় মৃদু ভলিউমে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বাজিয়ে পাশে রেখে তাস খেলতে বসে যায় দবির উদ্দিনসহ কয়েকজন। একটু দূরেই আমগাছের সাথে হেলান দিয়ে কানের কাছে রেডিও ধরে থাকা জমির শেখ একবার শুধু চোখ উল্টিয়ে তাকায়। কিন্তু কি যেন ভেবে কিছু না বলেই চোখ ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে।
অচিন্ত্যপুরের কাছাকাছি একটা নদী বন্দরে ঘাঁটি গেড়েছে পাকিস্তান মিলিটারী বাহিনীর কয়েকটা জাহাজ। সেই জাহাজগুলো ধ্বংস করে লুটবাহিনীর এ ঘাঁটি নিশ্চিহ্ন করে দিতে এগারো জনের একটি শক্তিশালী গেরিলা ইউনিট পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের হাই কমান্ড। বেশ কয়েকদিন ধরে অচিন্ত্যপুরের একটা গহিন জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে আছে গেরিলা কমান্ডোদের সেই ইউনিট। জমির শেখ সেই ইউনিটের দলপতি। অপারেশনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত জমির শেখের দল। কিন্তু হাইকমান্ড থেকে এখনো কোন সিগন্যাল আসেনি। জমির শেখ প্রতিটি মুহুর্ত হাইকমান্ডোর সিগন্যালের জন্য কান পেতে আছে।
কয়েকদিন অচিন্ত্যপুর জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে আছে মুক্তিবাহিনী। ইউনিটের দলপতি জমির শেখ ভীষণ চিন্তিত। দুশ্চিন্তার ছাপ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে তার চেহারায়। মনের গহিনে বাসা বাঁধছে অজানা শঙ্কা। কোনভাবে কি সিগন্যাল মিস করেছে সে! মনের ভেতর এমন প্রশ্নের উদয়ে কেঁপে ওঠে জমির শেখ। ‘না এমনটা হতেই পারে না’ নিজের মনকে শান্ত¦না দেয় সে। আরো একটু সতর্ক হয়ে নড়েচড়ে বসে। হাতে থাকা এক ব্যান্ডের রেডিওটা এগিয়ে ধরে কানের কাছে।
আজ অচিন্ত্যপুর জঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধাদের চতুর্থ দিন। সকাল সাতটা তিরিশ মিনিট। জমির শেখ সেই একইভাবে কানের কাছে, রেডিও নিয়ে আকাশবাণী শুনছে। গানের অনুষ্ঠান চলছে। দবির উদ্দিন হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। অবশ্য মাটির উপরে কিছু খড়কুটো বিছিয়ে নিয়েছিল। সারারাত পাহারার দায়িত্বে ছিল সে। অন্যান্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে আশেপাশে। কেউ বসে আছে গাছের সাথে হেলান দিয়ে। শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। ডুবে আছে ভাবনার গভীরে। ভাবনা জুড়ে একখন্ড স্বাধীন আবাস ভূমির প্রতিচ্ছবি।
হচকচিত হয়ে কান খাড়া করে বসল জমির শেখ। আকাশবাণীতে বাজছে একটা গান। গানটি তার খুব পরিচিত মনে হয়। আরেকটু মনোযোগ দিয়ে শোনে। উৎফুল্ল হয়ে ওঠে জমির শেখ। এটাইতো সেই গান! পঙ্গজ মল্লিকের, ‘আমি তোমায় যত গান শুনিয়েছিলাম’। যা বোঝার বুঝে গেছে সে। এই প্রথম উঠে দাঁড়ায় রেডিও রেখে। সবাইকে ডেকে নিয়ে বলে, ‘সবকিছু গুছিয়ে তৈরি হও। আজকালের মধ্যেই অপারেশন’।
সবাই নিজ নিজ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। শুধু জমির শেখ গভীর মনোযোগের সাথে রেডিও আকাশবাণী শুনছে। পরদিন একই সময় অর্থাৎ সকাল সাতটা তিরিশ মিনিট। আকাশবাণীতে প্রচারিত হল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের, ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি’ গানটি। এটা ছিল আক্রমনের চূড়ান্ত নির্দেশ। জমির শেখ রেডিও বন্ধ করল। চূড়ান্ত আক্রমনের প্রস্তুতি নিল তারা। মাল-মসলা সব রেডি আছে। একবার শুধু পরীক্ষা করে নিল।
সেদিন সন্ধ্যার পর। চারদিক ঘন অন্ধকার। এর মাঝেই লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে জমির শেখের দল। সদা ফূর্তিবাজ দবির উদ্দিনও জমির শেখের পাশাপাশি হাঁটছে।
রাত তখন দশটা। নদীর ধারে একটা ঝোপের আড়ালে এসে থেমেছে কমান্ডো দল। এখান থেকে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে নদীর ওপারে নোঙর করা আলো ঝলমল মিলিটারী জাহাজ। কমান্ডোগণ শেষবারের মত দোয়া দরুদ পড়ে তৈরি হয়ে নিল। প্রত্যেকে পায়ে ফিনস্ পরে নিল। গামছা দিয়ে প্রত্যেকে পেটের সাথে বাধলো প্রায় পাঁচ কেজি ওজনের নিমপেট মাইন। বিশেষভাবে কোমরের সাথে আটকে নিল একটি সার্ভিস নাইফ। সর্বপ্রথম নদীতে নামল জমির শেখ। এরপর একে একে সবাই।
খড়স্রোতা নদীর উন্মাতাল জলরাশির বুকচিরে, জীবনের মায়া ত্যাগ করে শত্রুসৈন্যের জাহাজের দিকে এগিয়ে চলেছে স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর এগারো জন কমান্ডো। দীর্ঘসময় সাঁতরিয়ে নদীর স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে শত্রু জাহাজের তলদেশে পৌঁছালো তারা। ছুরি দিয়ে জাহাজের তলার কিছু অংশের শেওলা চেছে পরিস্কার করে নিল। সেখানে ফিট করে দিল মাইন। মাইনের এ্যাকটিভ সূইচ অন করে দিয়ে প্রাণপনে সাঁতরাতে থাকে তীরের দিকে। বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে যে করেই হোক চার থেকে পাঁচশ গজ দুরে সরে যেতে হবে সাঁতরিয়ে। না হলে মাইন বিস্ফোরণের থেকে সৃষ্টি হওয়া শকওয়েভের ধাক্কায় বুকের মধ্যে হৃদপিন্ড ফেটে মৃত্যু ঘটার সম্ভাবনা নিশ্চিত।
কমান্ডোদের প্রত্যেকে অক্ষত অবস্থায় তীরে ফিরলো। ওদিকে মাইনের প্রচন্ড বিস্ফোরণে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাতটি জাহাজ তলিয়ে গেল। রাত তখন প্রায় আড়াইটা। এবার উল্টোদিকের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটতে লাগলো জমির শেখের দল। প্রচন্ড পানির পিপাসায় বুক শুকিয়ে আছে। অনেকদুর হেঁটে জঙ্গলের ভিতরে একটা পুকুর পাওয়া গেল। রাতের বাকী অংশ এখানেই থাকার সিদ্ধান্ত হল। পুকুরের পানি দিয়ে পিপাসা নিবারণ করলো দবির উদ্দিনসহ কয়েকজন।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। জমির শেখ পুকুরের পাড়ে নামল হাত-মুখ ধুয়ে নিতে। আঁৎকে উঠলো সে! পুকুরের¬ পাড়ে লাশের স্তুপ। পাকিস্তানি হানাদারদের বর্বরতার সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে কয়েকজন নারী, দুজন বৃদ্ধ, একটা শিশু আর তিনটে পুরুষের লাশ। সূর্য উঠে গেছে। শহীদের লাশের উপর গড়িয়ে পরছে সূর্যের আলো।
নিজের দল নিয়ে সামনে এগোতে থাকে জমির শেখ। বাতাসে ভেসে আসছে শিউলি ফুলের গন্ধ। সামনে একটা মেঠোপথ। পথের ধারে কয়েকটা খেঁজুর গাছ। তার পেছনে একটা মাঠ। কয়েকটা শূন্য ভিটা। কাশবন। এগোতে থাকে ওরা।
==0==
এখানে ক্লিক করে সাহিত্য সংবাদ পড়ুন।
এখানে ক্লিক করে দেখুন সাহিত্য সংবাদের ভিডিও।