সর্বশেষ লেখাসমূহ:

সত্যমিথ্যা করতালি সবখানে

Print Friendly, PDF & Email

সাযযাদ কাদির

পৃথিবীতে একটি কাজ আছে, তা করতে পারেন যে কেউ। এ কাজের জন্য কিছু জানার বা শেখার প্রয়োজন পড়ে না এতটুকু। বিশ্বাস হয় না? প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, সত্যিই আছে এমন এক কাজ। আমার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকেই দিচ্ছি সে কাজের খবর। কাজটি কবিতা লেখা। কবিতার আলোচনা করা। মনে ভাব থাকলে, হাতের কাছে কাগজ-কলম থাকলে, দিব্যি লেখা যায় কবিতা। কবিতা নিয়ে যা খুশি বলাও যায় সহজে। সেদিন এমন একজন কবি ও সমালোচক আমাকে বলেছেন, শামসুর রাহমান ব্যর্থ কবি। হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি ‘হাংরি’। অত্যন্ত জোর দিয়েই তিনি দাবি করেন এসব। কথাগুলো যে শুধু আমাকে বলেছেন তা নয়, বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থার নানা আয়োজনে নিয়মিত যোগ দেন তিনি, সে সব আসর-অনুষ্ঠানেও বলে থাকেন প্রায়ই। ওই সব অনুষ্ঠানে মূলত কবিতা পাঠ করেন তিনি, আলোচনায় যোগ দেন মাঝেমধ্যে। তাঁর কবিতা পাঠ সংবর্ধিত হয় বিপুল করতালিতে, বিজ্ঞ সমালোচকেরাও মুখর হন তাঁর উচ্চ প্রশংসায়। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, তাঁর কবিতার বই বেরিয়েছে পাঁচটি। ছ’ নম্বরটি প্রকাশের পথে। এছাড়া গল্পও লেখেন তিনি। ইংরেজি জানেন না। জানা দরকারও মনে করেন না। এক অনুষ্ঠানে তাঁর কবিতার হাতে লেখা কপি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। হাতের লেখা ভালোই, বেশ গোটা-গোটা। বানান ভুল দশটিতে পাঁচটি। ইচ্ছামতো শব্দ বসিয়ে-বসিয়ে পঙ্ক্তি নির্মাণ করেছেন, ফলে মাথামুণ্ডু নেই অর্থের। দুরান্বয় বা উল্লম্ফন বলতে গেলে তা গেছে সীমা বা মাত্রা সব ছাড়িয়ে। এক পঙ্ক্তির সঙ্গে অন্য পঙ্ক্তির কোনও দিক দিয়েই কোনও সংগতি নেই এতটুকু। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, তাঁর লেখার অসংগতি ও অর্থহীনতার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করতে এখানে উদাহরণ দিচ্ছি এক লোকরচনা থেকে- ‘ছুঁড়ে দিলাম ঢেঁকিটা… লাগলো কলা গাছে… হাঁটু ফেটে রক্ত পড়ে… চোখ গেল রে বাবা!’ এরকমই ‘কিসের সঙ্গে কি’ ধরনের লেখা লেখেন তিনি! এরপর তাঁকে বলি, এ লেখা তো বুঝতে পারছি না কিছু! তিনি বেশ রেগেই যান, বুঝবেন কেন? কবিতা কি বোঝার জিনিস? আমার কবিতা কেবল আমি বুঝবো। যত দুর্বোধ্য হবে, তত শ্রেষ্ঠ হবে কবিতা। তিনি জানান, এ ধরনের কবিতাই এখন বেশি চলছে মিডিয়ায়।
তাঁর মতো আরেকজনের কাছে শুনি, সুফি মরমী সাহিত্য বোগাস। রাবিশ। জানতে চাই বৈষ্ণব, সহজিয়া, বাউল, লালন, হাসন সম্পর্কে। পাত্তা দেন না মোটে। বলেন, রবীন্দ্রনাথ কিছু না, হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ কবি ‘দেও’। কবিতার বইসহ তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৯। ভালো কাটতি সেগুলোর। তিনিও উল্লিখিত জনের মতো বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থায়, অনুষ্ঠান-আসরে নন্দিত বন্দিত। কবিতা পড়েন, কবিতার আলোচনা করেন। ফেসবুক-এ তাঁর কবিতার ভক্ত-অনুরাগী অনেক। তাঁদের উচ্ছ্বসিত বাহবায় ভরা থাকে তাঁর ওয়াল। রাত জেগে মেতে থাকে অসংখ্য বন্ধুর আহা-বাহায়। তাঁর হাতের লেখা কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। বাংলা বানান দশটির মধ্যে সাতটি ভুল। ইংরেজিতে ভুল দশটিই। শব্দ বিন্যাস, পঙ্ক্তি নির্মাণÑজখাখিচুড়ি। পাঠশালার ছাত্র-ছাত্রীদের যদি বলা যায় ‘যা মনে আসো লেখো’, তবে তারা যে রকম যা লিখবে, প্রায়ই সে রকমেরই লেখা। তবে তিনি তো লিখবেন প্রেম- এই যা।
উল্লিখিত দু’জনের যথেষ্ট দাপট শাহবাগ, কাঁটাবন, টিএসসি, বাংলা একাডেমী, বিটিভি ও আরও অনেক কবিতীর্থে। তাঁদের অনেক খ্যাতি, অনেক ক্ষমতা। তবে পরিস্থিতি তো এরকমই। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা হয়তো জানতে চাইবেন, কি রকম? এ প্রশ্নের চমৎকার উত্তর দিয়েছেন কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন-

‘বিখ্যাত হতে সময় লাগে না
সিঁড়ি ছাড়া আকাশের তারা ছোঁয়া যায়
যোগ্যতা মেরুদণ্ডহীনতা সেই সঙ্গে তোষামোদী
পদলেহনের গুণ প্রশংসার্হ

পর্দায় মূর্ত হতে সময় লাগে না
অশুদ্ধ উচ্চারণ ডিজুস ভঙ্গি…
তারকাতৃষ্ণায় জনলোকে
সভ্যতার সিল্কবস্ত্র স্বেচ্ছায় খুলে ফেলছে দ্রৌপদীগণ
আর গোলাম ও খোজাদের খোঁজ করছে মিডিয়াবিদরা
আত্মসম্মানের বিনিময়ে কেউ কেউ ক্রোড়পতি
মর্যাদার মায়া পরিত্যাগ করে মল থেকে
তুলে নিচ্ছে কড়ি…
আত্মদানের যোগ্য যুবা নেই তবু মুক্তিযোদ্ধা হতে সময় লাগে না
এই মাৎস্যন্যায় মেনে নিচ্ছে কাপুরুষ কবি
পদপূরণের যোগ্য শব্দ নেই তবু লিখছে মিথ্যে মাতৃভাষা…
এই মৃত্যুদেশে নেতা হতে সময় লাগে না
মূক ও বধির সব জনতা সত্যমিথ্যা করতালি দেয়’…
(সময়ের গল্প, সব জন্মে শত্রু ছিল যে, ২০১১)
এইসব তোষামুদে, পদলেহী, গোলাম, খোঁজা, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, কাপুরুষ কবি, মূক ও বধির জনতা। সবাইকে কমবেশি চিনি আমরা, কিন্তু করণীয় কি? শরৎচন্দ্র সম্পর্কে বলা হয়, সমাজের নানা সমস্যা তুলে ধরেছেন তিনি, কিন্তু সমাধানের কথা বলেন নি, ইশারা-ইঙ্গিতও দেন নি কিছু। রেজাউদ্দিন স্টালিনও কি সময়ের কথা বলতে গিয়ে কেবল উল্লেখ করেই দায় সেরেছেন? চিহ্নিত ও লক্ষ্যবিদ্ধ করতে পারেন নি? নাকি কবিতায় ভগবানের বুকে পদচিহ্ন আঁকার কথা বলা গেলেও ভগবানের নাম বলা বারণ?
রেজাউদ্দিন স্টালিন অবশ্য নাম বলতে একেবারে বাকিও রাখেন নি অনেক ক্ষেত্রে। ওই ‘সময়ের গল্প’তেই লিখেছেন-
… ‘মাইক্রোক্রেডিটমুগ্ধ মেঘনাদ শান্তিপদকে ভূষিত
আর সুশীল সমাজ পুতুল নাচের পৃষ্ঠপোষক
বিশ্বব্যাংক বিভীষণদের হাতে তুলে দিচ্ছে বীরের তকমা…
এদেশে খনিজকন্যার জন্যে হিতৈষী হতে সময় লাগে না
সম্রাট কোষাগার সঁপে দিচ্ছে তঞ্চকের হাতে’…
এছাড়া কেবল লেখালেখিতেই ক্ষান্ত নন রেজাউদ্দিন স্টালিন। নানারকম কর্মসংস্কৃতিতেও তিনি উদ্যোগী। জীবিত কবিদের জন্মদিন উদযাপনের যে প্রথাটি সকল মহলের প্রিয়তা পেয়ে এখন রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত, এর নেপথ্যে রয়েছে তাঁরই উদ্যোগ-আয়োজন। মনে আছে, ১৯৯৩ সালের ২২শে নভেম্বর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে এক বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে নিজের ৩১তম জন্মদিন উদযাপন করেছিলেন রেজাউদ্দিন স্টালিন। সেদিন মুগ্ধ বিস্মিত হয়ের্ছিলেন অনেকে, কেউ-কেউ অবশ্য নাকও সিঁটকিয়েছিলেন। তবে এখন সকলের জন্য এক অবশ্যপালনীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এই শুভেচ্ছা-অনুষ্ঠান। এই সুযোগে রেজাউদ্দিন স্টালিনের ৫০তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখি। আর দু’দিন পরেই সে অনুষ্ঠান। তবে তাঁর কীর্তি আছে আরও। সেগুলোর একটি ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ নামের শুক্রবাসরীয় সান্ধ্য সাহিত্যিক আড্ডা গড়ে তোলা। আমাদের সেই ষাটের দশকের স্মৃতিবাহী শরিফ মিয়ার ক্যানটিনের সম্মুখস্থলে প্লাস্টিকের মাদুর পেতে এ কবিতার আসর বসছে ২০০৩ সালের এপ্রিলের কোনও এক শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে। শীত-বৃষ্টি উপেক্ষা করে খোলা চত্বরে প্রায় অব্যাহতভাবে অনুষ্ঠিত এ আসরে নিয়মিত যোগ দিচ্ছেন গড়ে ৪০-৫০ জন কবি। আসর পরিচালিত হয় একজন কবিকে ঘিরে। তাঁকে বলা হয় ‘মধ্যমণি’। আজকের আড্ডায় থাকবেন ৩৫০তম মধ্যমণি। অর্থাৎ এর আগে ৩৪৯ জন কবি ‘মধ্যমণি’ হিসেবে অলংকৃত করে গেছেন আসরকে।
‘ম্যাজিক লণ্ঠন’এর অনুষ্ঠানে থাকেন সভাপতি, সঞ্চালক, বক্তা ও আলোচক। কবিতা পাঠ ছাড়াও থাকে মধ্যমণির পরিচয় জ্ঞাপন, তাঁর উদ্দেশ্যে শুভেচ্ছা বক্তব্য, তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা। মধ্যমণি দুই দফায় পাঠ করেন দশ বা ততোধিক কবিতা, ধন্যবাদ জানান, নিজের কথা বলেন, কবিতা বিষয়ক ভাবনাও প্রকাশ করেন। এছাড়া উপস্থিত কবিরাও স্ব স্ব কবিতা পাঠ করেন, সে সব কবিতা নিয়ে আলোচনা হয় গুরুত্ব সহকারে।
আমারও একবার সৌভাগ্য হয়েছিল মধ্যমণি হবার। তখন বেশ ভালো লেগেছিল আসরের প্রাণময় পরিবেশ। এর পর থেকে সময় ও সুযোগ পেলে হাজির হয়ে যাই আসরে। পরিচিত হই নতুন-নতুন মধ্যমণি’র সঙ্গে, কিন্তু পুরনোদের অনেককেই দেখতে পাই না আর।
সুষ্ঠুভাবে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ পরিচালিত হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে কয়েকজনের সাংগঠনিক ঐকান্তিকতা। তাঁদের মধ্যে কবি রতন মাহমুদকে বলা যায় প্রাণপুরুষ। সংগঠন থেকে সঞ্চালন পর্যন্ত বেশিরভাগ দায়িত্বই পালন করেন তিনি। আরও একজনের কথা বলতে হয়। তিনি নিয়মিত বার্তা পাঠিয়ে মনে করিয়ে দেন আসর ও মধ্যমণি’র কথা। তাঁর নাম কুমার বিপ্লব। ১৪ সদস্যবিশিষ্ট সম্পাদনা পরিষদে রেজাউদ্দিন স্টালিন, রতন মাহমুদ, কুমার বিপ্লব ছাড়াও রয়েছেন আমিনুল গণি টিটো, স্বপন দেলওয়ার, ফরিদুজ্জামান, কামরুজ্জামান, শামীম সিদ্দিকী, আদিত্য নজরুল, নূর কামরুন নাহার, জামসেদ ওয়াজেদ, রমজান মাহমুদ, রুকসানা রহমান ও ফরিদ ভূঁইয়া। সংগঠনের সহকারী সম্পাদক আটজনÑজামিল জাহাঙ্গীর, কাজী সোহেল, শাকিল সারোয়ার, রাশেদ মামুন, জোবায়েদ সুমন, সাদিক মোহাম্মদ, বেলাল ফরাজি, লিন্ডা আমিন।
‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ মনে করিয়ে দেয় সতের শতকের ইতালির লাতেরনা মাজিকা বা ‘প্রতিচ্ছবি প্রক্ষেপক’এর ইতিহাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটমণ্ডল চত্বরে সহজ সাধারণ আয়োজনের মধ্য দিয়ে এককালের ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ও সৃষ্টি করে চলেছে সাহিত্যিক আড্ডার এক অনন্য ইতিহাস। এ পর্যন্ত অনেক সংঘ সমিতি সংগঠনের অনেক আয়োজন-অনুষ্ঠান দেখেছি, আরও অনেক দেখবো, তবে কবি ও কবিতার প্রতিচ্ছবি প্রক্ষেপণে যে সুদীর্ঘ আয়াসে নিবেদিত রয়েছে ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’, তা অবশ্যই স্থায়ী মূল্য পেয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে আমাদের সাহিত্যচর্চার সকল বৃত্তান্ত বিবরণীতে। আজকে তাঁদের ৩৫০তম আড্ডার সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করে অশেষ প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই সংশ্লিষ্ট সকল ‘জাদুদীপ’ধারীদের।

সর্বমোট পঠিত: 342

সর্বশেষ সম্পাদনা: নভেম্বর ৫, ২০১৮ at ১১:০২ পূর্বাহ্ণ

প্রিজম আইটি: ওয়েবসাইট ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট-এর জন্য যোগাযোগ করুন- ০১৬৭৩৬৩৬৭৫৭